দেশের মাটিতে মন্তব্য না আসিলেও বিদেশের মাটিতে দাঁড়াইয়া স্পষ্ট মন্তব্য করিতে পিছপা নহেন। হিন্দুত্বের অসহন লইয়া কথা না বলিলেও ইসলাম যদি সুফিবাদের দিকে আগাইত, তবে সমস্যা অনেক কম হইত বলিয়া ঘোষণা করিতে পারেন। আক্ষরিক ভাবেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অবস্থানের সহিত তাঁহার বক্তব্যের সংযোগটি বেশ ঘনিষ্ঠ। সেই প্রেক্ষিতেও যে তিনি আসিয়ান বৈঠকের মঞ্চে দাঁড়াইয়া পরিষ্কার বলিতে পারিয়াছেন যে, ধর্মের সহিত সন্ত্রাসের কোনও যোগ নাই, তাহা সত্যই সুসংবাদ। সন্ত্রাস যে দেশ-জাতি-ধর্ম সকল পরিচয়-বন্ধনীর বাহিরে একটি আলাদা মতাদর্শ, সন্ত্রাসবাদীদের যে কোনও ধর্মপরিচয়ের ঘেরাটোপে বিচার করাটা যে কেবল ভ্রান্ত নহে, অত্যন্ত বিপজ্জনক— এই কথাটি ভারতীয় জনতা পার্টির প্রধানমন্ত্রীর কাছ হইতে শুনিতে পাওয়াটা জরুরি ছিল। ইসলামিক স্টেট বা আই এস যতই নিজেদের প্রকৃত ইসলামি বলিয়া প্রতিষ্ঠা করিতে হিংস্র হইয়া উঠিবে, বাকি দুনিয়াকে ততই জোরের সহিত তাহার ইসলাম-অধিকার অস্বীকার করিতে কণ্ঠ চড়াইতে হইবে, তাহাতেই শান্তিপ্রিয় ধর্মভীরু মুসলিম বিশ্বনাগরিকের কল্যাণ। নরেন্দ্র মোদীর এই উচ্চারণের সূত্রে সন্ত্রাসবিরোধী সুর যে অনেকখানি চড়ানো গেল, তাহাতে সংশয় নাই। ভারত চির কালই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান লইয়াছে, সঙ্গে সঙ্গে নিজের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রটিও অতি সযত্নে রক্ষা করিয়া গিয়াছে। এখানেই ভারতের আন্তর্জাতিক মহিমা। সেই মহিমার দায় বিষয়ে যে প্রধানমন্ত্রী মোদীও যথেষ্ট সতর্ক, বিদেশের মাটিতে তাঁহার আত্মসচেতন উচ্চারণে তাহারই স্বাক্ষর। আশা করা যায়, তাঁহার সরকার ভারতের মাটিতেও কোনও মতেই ধর্মের সহিত সন্ত্রাসকে সম্পর্কিত করিবেন না, কিংবা হিংসাত্মক কার্যকলাপকে প্রশ্রয় দিবেন না।
আশার দ্বিতীয় উৎস প্রধানমন্ত্রী মোদীর পরবর্তী উচ্চারণ। তিনি বলিয়াছেন, ভারত একটি বৈচিত্রময় দেশ— প্রবাসী ভারতীয় সমাজ নিজেই যে বৈচিত্রের প্রতিনিধি, বৈচিত্র ও বহুত্ব ভারতের একটি গুরুতর সম্পদ। গত কিছু কাল ধরিয়া নানা কারণেই দেশের নাগরিক সমাজের এক বিরাট অংশ মনে করিতেছিলেন যে, ভারতের বহুত্বের প্রতি মোদীর কোনও মমতা নাই, কেবল হিন্দুত্বের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার উদ্বেগ ও উদ্যোগেই তাঁহার সরকার সর্বশক্তি ব্যয় করিতে চাহে। বেশ কয়েকটি হিন্দু উগ্রবাদী হামলায় প্রধানমন্ত্রী ও তাঁহার প্রশাসনের নীরবতার এই অর্থই করা হইয়াছিল। আজ ভারতীয় লেখক-শিল্পী সমাজের যে প্রবল প্রতিবাদ দেশব্যাপী ধ্বনিত হইতেছে, তাহার অনেকটাই মোদীর ‘নীরবতা’কে সম্মতি ধরিয়া লইয়া উৎসারিত। সেই দিক হইতে, প্রধানমন্ত্রীর আস্থাজ্ঞাপক বাক্যগুলি উল্লেখযোগ্য। অবশ্য প্রতিবাদী সমাজ ইহাতে আশ্বস্ত বোধ করিবেন কি না, তাহা নির্ভর করিতেছে দেশের মাটিতে ফিরিয়াও প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠস্বর একই থাকে কি না, তাহার উপর।
ক্ষমতাসীন হইবার পর হইতেই প্রধানমন্ত্রী দেশপ্রধান হিসাবে তাঁহার আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে বিশেষ সচেতন। গত আঠারো মাসে তিনি দেশে কতখানি সময় ব্যয় করিয়াছেন, আর কতখানি বিদেশে, তাহা খতাইয়া দেখিলেই তাঁহার এই অতি-সচেতনতার পরিমাণটি বোঝা যাইবে। একটি কথা তিনি নিশ্চয়ই জানেন। তাঁহার গ্রহণযোগ্যতার বহুলাংশ, প্রায় সর্বাংশই, কিন্তু ভারতের উন্নতশির গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্র পরিচয়টির উপর নির্ভরশীল। বহির্দুনিয়া তাঁহাকে কী ভাবে দেখিবে, কী ভাবে মনে রাখিবে, তাহা নির্ভর করিবে তিনি কী ভাবে ভারতকে রাখিতেছেন, তাহার উপরেই। ভারত কী ছিল, কী হইতেছে, কী হইবে: ভিতরে বাহিরে সবাই সবই দেখিতেছেন, সবই দেখিবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy