বন্ধু বাছিয়া লওয়া যায়, প্রতিবেশী বাছিয়া লইবার উপায় নাই। পুরানো, পরিচিত কথাটি নূতন করিয়া মনে পড়াইয়া দিয়াছে সাম্প্রতিক দুইটি সংবাদ। প্রথম সংবাদ: আরব সাগরের উত্তরাংশের জল ক্রমেই মৎস্য প্রজননের প্রতিকূল হইয়া উঠিতেছে। একটি সম্ভাব্য কারণ: দুই প্রতিবেশী দেশ, বিশেষত তাহাদের বড় শহর হইতে ওই সাগরজলে নিক্ষেপ করা দূষিত, বর্জ্য তরল। দেশ দুইটির নাম: ভারত এবং পাকিস্তান। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যাইতেছে, কেবল মুম্বই হইতেই ২৭০ কোটি লিটার দূষিত জল পুনর্ব্যবহারযোগ্য না করিয়াই প্রতিদিন আরব সাগরে ফেলা হইতেছে, করাচি হইতে ফেলা দূষিত জলের পরিমাণ দৈনিক ১৬০ কোটি লিটার। ইহার ফলে সাগরের উত্তরাংশে অক্সিজেনের পরিমাণ এমন ভাবে হ্রাস পাইতেছে যে, মৎস্য প্রজননও আর আগের মতো হইতেছে না। ফলে দুই বছর আগে যেখানে ভারতীয় মৎস্যজীবীরা সাড়ে আট লক্ষ টন মাছ এই অঞ্চল হইতে ধরিয়াছিলেন, তাহার পরিমাণ দ্রুত হ্রাস পাইতেছে। এক দিন হয়তো মৎস্যসম্পদে সমৃদ্ধ ওই সাগরে হাজার জাল ফেলিয়াও মাছ উঠিবে না। দুই প্রতিবেশীকেই সমস্যা নিরসনে আগাইয়া আসিতে হইবে। আর সে জন্য প্রয়োজন দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা।
দ্বিতীয় সংবাদ: সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের দুই পারেই কাশ্মীরবাসী জনসাধারণ ব্যাপক, আকাশভাঙা বৃষ্টি, ও হিমবাহের গলন এবং নদীগুলির জলোচ্ছ্বাসের ফলে যে বন্যা এবং যত ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন, উভয় দেশের রাষ্ট্রপ্রধানই তাহার মোকাবিলা করিতে পরস্পরকে অর্থ, রসদ ও পরিকাঠামো দিয়া সাহায্য করার আশ্বাস দিয়াছেন। দুই যুযুধান প্রতিবেশী দুর্গত মানুষের উদ্ধার, ত্রাণ ও পুনর্বাসন লইয়া কোনও রেষারেষি করিতেছে না, কোনও কূটনৈতিক কূটকচালিও করিতেছে না, বরং পরস্পরের পাশে দাঁড়াইবার, কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া যৌথ ভাবে লড়াই করার বাসনা ব্যক্ত করিতেছে। আরব সাগরের ‘যৌথ দূষণ’-এর মতোই এ ক্ষেত্রেও ভূগোলের বাস্তব দুই রাষ্ট্রকে এক নৌকায় তুলিয়া দিয়াছে। পরিস্থিতির চাপ যদি রাষ্ট্রযন্ত্রীদের পারস্পরিক সহযোগিতায় অনুপ্রাণিত করে, তাহা উপমহাদেশের বাসিন্দাদের উপরি-পাওনা বলিয়াই গণ্য হইবে।
এই ধরনের সংকট জানাইয়া দেয়, ইতিহাস এবং রাজনীতির যূপকাষ্ঠে ভূগোলের বাস্তবকে কী ভাবে বলি দেওয়া হয় এবং সেই বাস্তবকে উদ্ধার ও সম্মান করিতে পারিলে কী ধরনের সম্ভাবনা তৈয়ারি করা যায়। একটি দৃষ্টান্ত: সিয়াচেন হিমবাহ। এই অঞ্চলটির অনুপম সৌন্দর্য ও পার্বত্য দুর্গমতার সংশ্লেষ মেরুপ্রদেশকেও হার মানায়। অন্য রকম ভ্রমণে আকৃষ্ট পর্যটকদের কাছে এই অঞ্চলকে পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়িয়া তুলিবার সুযোগ বিপুল। অথচ এই ‘ঈশ্বর-পরিত্যক্ত’ হিম-ঘরে দুই দেশের সেনাবাহিনী মুখোমুখি বসিয়া পরস্পরের দিকে সঙিন উঁচাইয়া আছে। তাহাদের জওয়ানরা কোনও যুদ্ধ ছাড়াই স্রেফ প্রবল ঠান্ডা, তুষার-ধস, হিমানী সম্প্রপাত ও ঝোড়ো হাওয়ার দাপটে দলে-দলে মারা যাইতেছেন। কী হইতে পারে এবং কী হইয়াছে, তাহার দূরত্ব এমন অ-পরিসীম হইবার পিছনে যে রাষ্ট্রনীতি, তাহা সহজে পালটাইবে না, পালটাইবার নহে। কিন্তু সেই নীতির আবরণ সরাইয়া মাঝে মাঝে সম্ভাবনার চিত্রটি যখন জাগিয়া উঠে, তখন দুই দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকরা এক বার স্বপ্ন দেখিবার সুযোগ পান। স্বপ্ন অমূল্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy