কখনও না হওয়া অপেক্ষা বিলম্বে হওয়া শ্রেয়। দিল্লি গত বছর যাহা ভাবিয়াছিল, কলিকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গ আজ তাহা ভাবিতেছে। কলিকাতা, যাদবপুর, রবীন্দ্রভারতী, বর্ধমান সহ রাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই শিক্ষাবর্ষ হইতে ভর্তির আবেদনপত্রে ‘পুরুষ’ এবং ‘নারী’ ছাড়া ‘অন্যান্য’ লিঙ্গপরিচয় জানাইবার সুযোগ রাখা হইতেছে। অর্থাৎ ‘তৃতীয় লিঙ্গ’-এর নাগরিকরা নিজ পরিচয়েই আবেদন করিতে পারিবেন, নিজেদের নারী বা পুরুষ তকমায় আঁটিবার কোনও বাধ্যতা তাঁহাদের থাকিবে না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে এই ছাড়পত্র মঞ্জুর করিতেছেন, এমন নহে। গত বছর এপ্রিল মাসে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়াছিল, ট্রান্সজেন্ডার বর্গের মানুষদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হইবে। অতঃপর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসি সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়কে সেই অনুসারে ব্যবস্থা করিতে বলে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বছরেই এই ব্যবস্থা সারিয়া ফেলিয়াছিল। পশ্চিমবঙ্গ এক বছরের মধ্যেই মহাজনের পথ অনুসরণ করিতে পারিয়াছে। সাধু।
ভারতীয় সমাজে লিঙ্গপরিচয়ের বিভিন্নতা আজও তাহার প্রাপ্য স্বীকৃতি পায় নাই। আইনেও ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌন আচরণ’ আজ অবধি অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত। সুপ্রিম কোর্টের সুস্পষ্ট নৈতিক অনুশাসনের পরেও সরকার বা সাংসদরা ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা সংশোধন করেন নাই, করিবার কোনও উদ্যোগও এ অবধি দেখা যায় নাই। সরকার তথা সাংসদরা দেশকে পুরানো ধ্যানধারণার দাসত্ব হইতে নূতন চিন্তার মুক্ত পরিসরে উত্তীর্ণ করিবেন, ইহাই কাম্য, কিন্তু এ দেশে যত দিন যাইতেছে, প্রবণতা তাহার বিপরীত— সমাজ যত না পশ্চাদ্মুখী, রাজনীতিকরা তাহার দ্বিগুণ। বিশেষত যৌন আচরণ বা লিঙ্গ-সত্তার প্রশ্নে তো ভারতীয় রাজপুরুষরা মধ্য-ভিক্টোরীয় জ্যেষ্ঠতাতদেরও লজ্জা উৎপাদন করিতেন। দুর্ভাগ্যের কথা, যে রাজনীতিকরা ব্যক্তিগত চিন্তায় আধুনিক, উদার, তাঁহারাও সচরাচর এই ধরনের প্রশ্নে যথেষ্ট তৎপরতা ও বলিষ্ঠতার সহিত আগাইয়া আসেন না, আসিলে ৩৭৭ ধারা আজও নির্বিবাদ বহাল থাকিত না। অনুমান করা যায়, তাঁহারা অথবা তাঁহাদের দলনেতারা ভোট হারাইবার ভয়ে সতত ত্রস্ত। এই পরিস্থিতিতে সমাজের অগ্রবর্তী অংশকেই সংস্কারের কাজে অগ্রণী হইতে হইবে।
সেখানেই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ম পরিবর্তনের বাড়তি তাৎপর্য। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় নূতন চিন্তা ও চেতনার উন্মেষের পক্ষে অতি প্রশস্ত পরিসর। বিশেষত, বর্তমান দুনিয়ায় যৌন আচরণের স্বাধীনতা ঘোষণায় ও তাহার অধিকার দাবিতে ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কর্তৃপক্ষ তৃতীয় লিঙ্গকে স্বীকৃতি দিয়া পরোক্ষে এই ভূমিকাকেও মর্যাদা দিয়াছেন। আশা করা যায়, প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি অতঃপর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরে সামাজিক আচরণেও সুপ্রভাব ফেলিবে। এখনও তৃতীয় লিঙ্গের প্রতি সমাজের, এমনকী তরুণ ছাত্রছাত্রীদেরও একটি বড় অংশের মনোভাবে এক ধরনের বিরূপতা এবং অমর্যাদার প্রতিফলন ঘটিয়া থাকে, ফলে ‘অন্য যৌনতা’র মানুষরা প্রায়শই অবজ্ঞা ও অপমানের শিকার হন। আইন বা বিধি বদলালেই রাতারাতি এই মানসিকতা বিলুপ্ত হইবে না। সেখানেই উদারমনস্ক ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের নৈতিক দায়িত্ব। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে তৃতীয় লিঙ্গ যাহাতে কেবল ব্যবহারিক স্বীকৃতি নয়, আচরণগত মর্যাদা পায়, তাহা নিশ্চিত করিবার দায়িত্ব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy