Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

সুবিধা বনাম নীতি

ব্যর্থতার ধারাবাহিকতা ভাঙিয়া অরুণ জেটলি ‘পণ্য ও পরিষেবা কর’-এর জন্য প্রয়োজনীয় সংবিধান সংশোধনীর প্রস্তাবটি সংসদে পেশ করিলেন। দেশের বেশির ভাগ বৃহত্‌ রাজ্যেই যেহেতু এখন বিজেপি-র সরকার, অরুণ জেটলি আশাবাদী হইতে পারেন। করটি চালু হইলে ক্রেতার কিছু সুবিধা হইবে, সংশয় নাই।

শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০১
Share: Save:

ব্যর্থতার ধারাবাহিকতা ভাঙিয়া অরুণ জেটলি ‘পণ্য ও পরিষেবা কর’-এর জন্য প্রয়োজনীয় সংবিধান সংশোধনীর প্রস্তাবটি সংসদে পেশ করিলেন। দেশের বেশির ভাগ বৃহত্‌ রাজ্যেই যেহেতু এখন বিজেপি-র সরকার, অরুণ জেটলি আশাবাদী হইতে পারেন। করটি চালু হইলে ক্রেতার কিছু সুবিধা হইবে, সংশয় নাই। এখন দেশে পরোক্ষ কর আদায়ের যে পদ্ধতিটি প্রচলিত, তাহাতে একই পণ্যের উপর, উত্‌পাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে, বিবিধ কর আরোপিত হয়। পণ্য ও পরিষেবা কর (ইংরাজিতে গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স বা জিএসটি) চালু হইলে মোট করের পরিমাণ কমিবে, ফলে ক্রেতার লাভ। সরকারেরও লাভ, কারণ এই কর চালু হইলে অনেক বেশি পণ্য ও পরিষেবা করের আওতায় আসিবে। হিসাব বলিতেছে, দেশের অভ্যন্তরীণ উত্‌পাদন বৃদ্ধির হারও এক শতাংশের কাছাকাছি বাড়িতে পারে।

এই কর ব্যবস্থা লইয়া অনেক রাজ্যেরই আপত্তি। কিন্তু, সেই আপত্তির কারণ নীতিগত নহে, ব্যবহারিক। তাহাদের আশঙ্কা, এই নূতন ব্যবস্থায় রাজ্যের রাজস্বের পরিমাণ কমিবে। অরুণ জেটলি আগামী পাঁচ বত্‌সর ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিয়া সেই আপত্তির সুরাহা করিয়াছেন। এই আপত্তিটি অবশ্য, প্রকৃত প্রস্তাবে, গৌণ। মুখ্য আপত্তি নীতিগত। জিএসটি নামক করব্যবস্থাটি ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতি ও আদর্শের পরিপন্থী। গোটা দেশ জুড়িয়া অভিন্ন বাজার প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে কেন, তাহার কোনও নীতিসম্মত সদুত্তর নাই। দেশের রাজ্যগুলির মধ্যে বাণিজ্য উদার হওয়াই বিধেয়। কিন্তু, কোন রাজ্য সেই উদার বাণিজ্যের পথে কয় কদম হাঁটিবে, তাহা স্থির করিয়া দেওয়ার অধিকার কেন্দ্রীয় সরকারের নাই। পণ্য বা পরিষেবার আমদানি-রফতানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা অগ্রহণযোগ্য, কিন্তু কর বা শুল্ক তো নিষেধাজ্ঞা নহে। সংবিধান সংশোধন করিয়া সরকার পরোক্ষ করকে কেন্দ্রের বিচারাধীন তালিকায় লইয়া যাইতেছে। সম্পূর্ণ বিপরীত গতি বিধেয় ছিল। পরোক্ষ কর আদায়ের বিষয়টি যৌথ তালিকাতেও নহে, সম্পূর্ণ রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত হওয়া প্রয়োজন। এমনকী, প্রবেশ শুল্ক আরোপের অধিকার থাকা বাঞ্ছনীয়। এমন নহে যে রাজ্য এই করগুলি আরোপ করিলে তাহার ফলাফল সর্বদা ইতিবাচক। কিন্তু, কর আরোপ করিবার কুফল সেই কর আরোপের অধিকার কাড়িয়া লওয়ার যুক্তি হইতে পারে না। রাজ্যের ভৌগোলিক পরিসরে রাজস্ব আদায়ের (বা অনাদায়ের) সিদ্ধান্তের অধিকারী কেবলমাত্র রাজ্য সরকারই হইতে পারে— ইহাই যুক্তরাষ্ট্রীয়তার নীতি হওয়া বিধেয়। জিএসটি ইহার পরিপন্থী, অতএব নীতিগত ভাবে সমস্যাসঙ্কুল।

শুধু পরোক্ষ করই বা কেন? আয়কর আদায়ের অধিকারই বা কেন রাজ্যগুলির হইবে না? কেন্দ্রের উন্নয়ন কর্মসূচি চালাইবার জন্য কর আদায়ের অধিকারের প্রয়োজন নাই। অর্থ কমিশনের মাধ্যমে সেই ব্যবস্থা সম্ভব। কোন রাজ্যে কী হারে কাহার নিকট হইতে আয়কর আদায় করা হইবে, তাহা রাজ্য সরকার স্থির করুক। তাহাতে রাজ্যের শিল্প পরিস্থিতির উপর প্রভাব পড়িবে, রাজকোষের উপর তো বটেই। কোনও রাজ্য সরকার অবিমৃশ্যকারী হইলে সেই রাজ্য ভুগিবে। এখানেই ভোটদাতার দায়িত্ব। কাহার হাতে রাজস্ব নীতি থাকিলে রাজ্য বিপথগামী হইবে না, সেই সিদ্ধান্তও তাঁহাদেরই করিতে হইবে। ব্যালট বাক্সে। সিদ্ধান্তে ভুল হইলে দুর্ভোগ মানিয়া লইতে হইবে। কিন্তু, রাজ্য সরকার ভুল করিতে পারে বলিয়াই সব ক্ষমতা কেন্দ্রের হাতে থাকিবে, এমন অভিভাবকতন্ত্রের প্রয়োজন নাই। বস্তুত, কেন্দ্রই সব ক্ষমতার স্বাভাবিক অধিকারী, রাজ্যগুলির কিছু পাইতে হইলে তাহা কাড়িয়া লইতে হইবে, এই মানসিকতাটি দূর করা আবশ্যক। যথার্থ যুক্তরাষ্ট্রের তাহাই দাবি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE