পশ্চিমবঙ্গের দুর্ভাগ্য, মাত্র কয়েকটি ‘সামান্য/ছোট/তুচ্ছ ঘটনা’-ই এই রাজ্যের ভবিষ্যৎ কাড়িয়া লইল। ‘সামান্য ঘটনা’ শব্দবন্ধটি সম্ভবত সাংকেতিক। তাহার অর্থ, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে, বিচ্ছিন্ন ভাবে, আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের ঘটনা। যেমন, রাজারহাটে সিন্ডিকেট-যুদ্ধ, বামনগাছিতে প্রতিবাদী-হত্যা অথবা বর্ধমানে ইস্পাত কারখানার রেল সাইডিং-এর দখল লইয়া অশান্তি। আপাতদৃষ্টিতে একটি ঘটনার সহিত অন্যটির যোগ নাই, একক ভাবে কোনও ঘটনাই রাজ্যব্যাপী প্রভাব বিস্তার করিবার মতো বড় নহে, কাজেই ঘটনাগুলিকে গুরুত্ব দেওয়াও সম্ভবত প্রশাসন বাহুল্য মনে করে। মুখ্যমন্ত্রী হয়তো জানিয়া অবাক হইবেন যে ঘটনাগুলি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ, দুই গোত্রের প্রভাব ফেলিয়া থাকে। তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বের সামান্য ঘটনায় বর্ধমানের শ্যাম স্টিল-এর কারখানায় যে অচলাবস্থা তৈরি হইয়াছে, তাহা প্রত্যক্ষ প্রভাবের নিদর্শন। পরোক্ষ প্রভাব দুই গোত্রের। প্রথম, একটি ঘটনায় অপরাধীরা নেতাদের বদান্যতায় বেকসুর ছাড়া পাইয়া গেলে আরও অনেকে সমগোত্রের অপরাধে উৎসাহ পায়। হলদিয়ায় এবিজি গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করিয়া গত বৎসরের বিশৃঙ্খলায় জড়িতদের কঠোর শাস্তি হইলে হয়তো শ্যাম স্টিলের ঘটনাটি ঘটিত না। দ্বিতীয় পরোক্ষ প্রভাব বিনিয়োগকারীদের উপর। রাজ্যের শাসকরা আইনের শাসন বজায় রাখিতে আগ্রহী এবং সক্ষম, শিল্পপতিদের মনে এই বিশ্বাস না থাকিলে বিনিয়োগ আসা কঠিন। তাঁহাদের নিকট পুঁজির নিরাপত্তাই সর্বাপেক্ষা জরুরি। হলদিয়া হইতে জামুড়িয়া বা ভদ্রেশ্বর, রাজারহাট হইতে কামদুনি, রাজ্যের প্রতিটি প্রান্তে অহরহ প্রমাণ হইতেছে যে প্রশাসন আইনের শাসন বজায় রাখিতে অক্ষম, সম্ভবত অনিচ্ছুক।
দলের নিচু তলার কর্মী-সমর্থকরা যাহা করিতেছেন, তাহাই পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে মারাত্মক। খাঁড়ার ঘা দেওয়ার কাজটি মুখ্যমন্ত্রী না করিলেও এই রাজ্যের অন্তর্জলি যাত্রা কেহ ঠেকাইতে পারিত না। মুখ্যমন্ত্রী সম্ভবত ঝুঁকি লইতে নারাজ। তিনি প্রায় নিয়ম করিয়া অভিযুক্তদের আড়াল করিয়া থাকেন। শ্যাম স্টিলের ঘটনাতেও তিনি জানাইয়াছেন, তিনি ‘এনকোয়ারি’ করিয়া দেখিয়াছেন, কথা-কাটাকাটির অতিরিক্ত কিছুই ঘটে নাই! তদন্তের দায়িত্ব কে তাঁহার স্কন্ধে অর্পণ করিল, উত্তরবঙ্গে বসিয়া বর্ধমানের ঘটনার তদন্ত তিনি কী পদ্ধতিতে করিলেন, প্রশ্নগুলি অবান্তর, কারণ তাঁহার উদ্দেশ্যটি অনুমেয়। অনুব্রত মণ্ডলাদি পারিষদদের প্রতি তাঁহার সস্নেহ প্রশ্রয় লক্ষ করিলেই তাহা বোঝা যায়। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব যাঁহার, তিনিই যদি আইনভঙ্গকারীদের আশ্রয়দাত্রী হন, এই রাজ্যের উপর ভরসা করিবেন কে? মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য মাঝেমধ্যেই বলিয়া থাকেন, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, তোলাবাজি ইত্যাদি বরদাস্ত করিবেন না। কথা এবং কাজের সমন্বয় সাধন কে করিবে? কবেই বা?
অর্থনীতিবিদ প্রণব বর্ধন সম্প্রতি বলিলেন, তরুণ প্রজন্মের জন্য কর্মসংস্থান না করিতে পারিলে তাহারা অপরাধের পথেই হাঁটিবে। পশ্চিমবঙ্গে প্রক্রিয়াটি আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। পর্যবেক্ষণটির যাথার্থ্য অনস্বীকার্য। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে যাহা চলিতেছে, তাহা একটি বিষচক্র কাজ নাই বলিয়া সমাজে অপরাধের প্রবণতা বাড়িতেছে, এবং সমাজটি বিশৃঙ্খল, অপরাধপ্রবণ হইয়া উঠিয়াছে বলিয়া বিনিয়োগও আসিতেছে না, ফলে কাজও নাই। এই বিষচক্রটি ছেদ করা সম্ভব, কিন্তু তাহার জন্য প্রশাসনিক সক্রিয়তা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে কোনও আপস চলিবে না। কেবলমাত্র শিল্পসংক্রান্ত বিরোধের ক্ষেত্রেই নহে, আইনভঙ্গের সব ঘটনাতেই প্রশাসন সমান তৎপর হইলে হয়তো কিছু বৎসর পরে এই রাজ্যের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিতেও পারে। কিন্তু তাহার জন্য কাজ চাই, মুখ্যমন্ত্রীর বচনামৃত যথেষ্ট হইবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy