Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

সাম্যবাদ

ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণ তৃতীয় পাণ্ডবকে বলিয়াছিলেন: হে পার্থ, ক্লৈব্য স্বীকার করিয়ো না। ভগবদ্‌বাক্যের মহিমা অপার, এত কাল পরেও সেই আহ্বান শুনিয়া পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী বীরবিক্রমে জাগিয়া উঠিয়া ভীমবেগে কাজে নামিয়া পড়িয়াছেন। কাজ নহে, কুকাজ।

শেষ আপডেট: ২১ মে ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণ তৃতীয় পাণ্ডবকে বলিয়াছিলেন: হে পার্থ, ক্লৈব্য স্বীকার করিয়ো না। ভগবদ্‌বাক্যের মহিমা অপার, এত কাল পরেও সেই আহ্বান শুনিয়া পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী বীরবিক্রমে জাগিয়া উঠিয়া ভীমবেগে কাজে নামিয়া পড়িয়াছেন। কাজ নহে, কুকাজ। পশ্চিমবঙ্গের উচ্চশিক্ষার কফিনে এখনও যে দুই একটি পেরেক ঠোকা বাকি আছে, মহামান্য পার্থ চট্টোপাধ্যায় স্থির করিয়াছেন, সেগুলি তিনি নিজের হাতে ঠুকিয়া যাইবেন। রাজ্যবাসী জানেন, তিনি যন্ত্রমাত্র, এ বঙ্গভূমিতে যন্ত্রী এক জনই। তবু, মানিতেই হয়, ইচ্ছাময়ী আপন ইচ্ছা পূরণের জন্য শিক্ষামন্ত্রীর আসনে একখানি যন্ত্র পাইয়াছেন বটে! তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে বন্ধের দিনে ছাত্রছাত্রীদের আতান্তরে ফেলিয়া পরীক্ষা চালু রাখিতে বাধ্য করেন, প্রশ্ন তুলিলে বলেন: বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ যখন দিই, তখন আদেশও দিব বইকী! উচ্চ শিক্ষা সংসদের শীর্ষাসনে পছন্দের শিক্ষাবিদ রাখিয়াও আর মন ওঠে না, নিজেই সেই আসনে বসিয়া পড়েন। মন্ত্রিমহাশয়ের সাম্প্রতিক কীর্তি: রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির নববিধান। সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর স্তরে ভর্তির জন্য যাহাতে একটি অভিন্ন প্রবেশিকা পরীক্ষার আয়োজন করা যায়, সেই উদ্দেশ্যে বিধানসভায় আইন প্রণীত হইয়াছে।

ছাত্র ভর্তির নীতিতে যে পরিবর্তন আবশ্যক ছিল, ইহা তাহার বিপরীত। কোন বিশ্ববিদ্যালয় কী ভাবে ছাত্র ভর্তি করিবে, তাহা সম্পূর্ণত তাহার বিচার্য। বস্তুত, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি বিভাগের এই ব্যাপারে নিজস্ব নীতি নির্ধারণের স্বাধীনতা থাকা উচিত। দুনিয়ার প্রথম সারির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে তাহাই হয়। এ রাজ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও তেমন নীতি অনুসৃত হয়। সেই স্বাধীনতাই প্রসারিত হওয়া কাম্য ছিল। স্বাধীনতার যুক্তি সহজ। প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক বিভাগ বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানস্বরূপ। পঠনপাঠনের নীতি নির্ধারণে প্রত্যেকের নিজস্ব ধারণা থাকাই স্বাভাবিক। চিন্তার স্বাধীনতা প্রকৃত শিক্ষার অত্যাবশ্যক শর্ত। ছাত্র ভর্তির পদ্ধতি স্থির করিবার স্বাধীনতা সেই শর্ত পূরণের প্রথম পদক্ষেপ। রাজ্য সরকার শিক্ষার স্বাধীনতাকে গোড়া হইতেই কাটিয়া দিবার ব্যবস্থা পাকা করিয়া ফেলিল।

কেন এই বিপরীতবুদ্ধি? এক, সকলকে ‘সমান’ করিবার ধারণা। এই ভুল সাম্যবাদ উচ্চশিক্ষার উত্‌কর্ষের পথে বিরাট বাধা। সাম্য নয়, স্বাধীনতাই উচ্চশিক্ষার যথার্থ ভিত। কিন্তু আলিমুদ্দিন হইতে কালীঘাট— সাম্যবাদ চলিতেছে, চলিবে। দুই, তাহার সহিত চলিবে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর সরকারি আধিপত্য বিস্তারের প্রকল্প। ইহাও পূর্ব-জমানার ঐতিহ্য, উত্তরসূরিরা দ্বিগুণ উত্‌সাহে বহন করিয়া চলিতেছেন। সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি প্রবেশিকা পরীক্ষার আয়োজন হইলেই আধিপত্যের সুযোগ অনেক বাড়িয়া যায়। দুর্জনে বলিবে, দলতন্ত্রের দুষ্টামির সুযোগও বাড়িয়া যায়, কিন্তু সে প্রসঙ্গ আপাতত থাকুক। তবে এই দুই উপসর্গেরই মূলে একটি গভীর ব্যাধি: রাষ্ট্রসর্বস্বতা। কোনও প্রতিষ্ঠানের উপর, এমনকী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরেও আপন ভাগ্য নির্ধারণের ভার ছাড়িয়া দেওয়া যায় না, সবই রাষ্ট্রকে করিতে হইবে— এই ধারণা ভারতীয় নীতিকারদের মজ্জাগত। লক্ষণীয়, এ ক্ষেত্রে কোনও কেন্দ্র-রাজ্য বিবাদ নাই। অনিল বিশ্বাস ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কপিল সিব্বল এবং স্মৃতি ইরানি, সকলেই উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রীকরণে প্রবল আগ্রহী। অভিন্ন প্রবেশিকা পরীক্ষায় কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারেরও উত্‌সাহের অন্ত নাই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE