Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

সাম্রাজ্য ও জাতীয়তা: মুক্ত মনের সন্ধানী

তিনি ছিলেন ভারতীয় ইতিহাসচর্চার শ্রেষ্ঠ ব্রিটিশ পণ্ডিত, বিশ্ব ইতিহাসের এক অসামান্য বিশ্লেষক এবং এক অনন্য শিক্ষক, যিনি পরবর্তী প্রজন্মের ইতিহাসবিদদের প্রভূত প্রেরণা দিতে পারতেন। বিদায় নিলেন ক্রিস বেয়্‌লি।১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে এক সন্ধ্যায় সেন্ট ক্যাথারিন’স কলেজের হলে একটা কোণে বসে চুপচাপ রাতের খাওয়া সারছিলাম। সে দিনই বিকেলে কেমব্রিজে পৌঁছেছি। বেশ একটু একা লাগছিল। আর এক জন ছাত্র আমার কাছে এসে আমার পরিচয় জেনে নিল, তার পর বলল, ডক্টর বেয়্‌লি বলেছেন আমি যেন ডিনারের পরে তাঁর সঙ্গে দেখা করি। ক্রিস বেয়্‌লি তখন পোর্টার্স’ লজ-এর একেবারে ওপরতলায় থাকতেন। সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলাম তাঁর বাড়িতে।

দিশারি। ইতিহাস গবেষণায় নতুন পথ দেখিয়েছিলেন ক্রিস্টোফার বেয়্‌লি (১৯৪৫-২০১৫)‌। নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো, কলকাতা, ২০০৭।

দিশারি। ইতিহাস গবেষণায় নতুন পথ দেখিয়েছিলেন ক্রিস্টোফার বেয়্‌লি (১৯৪৫-২০১৫)‌। নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো, কলকাতা, ২০০৭।

সুগত বসু
শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে এক সন্ধ্যায় সেন্ট ক্যাথারিন’স কলেজের হলে একটা কোণে বসে চুপচাপ রাতের খাওয়া সারছিলাম। সে দিনই বিকেলে কেমব্রিজে পৌঁছেছি। বেশ একটু একা লাগছিল। আর এক জন ছাত্র আমার কাছে এসে আমার পরিচয় জেনে নিল, তার পর বলল, ডক্টর বেয়্‌লি বলেছেন আমি যেন ডিনারের পরে তাঁর সঙ্গে দেখা করি। ক্রিস বেয়্‌লি তখন পোর্টার্স’ লজ-এর একেবারে ওপরতলায় থাকতেন। সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলাম তাঁর বাড়িতে। ঘরে ঢুকে দেখলাম, সবুজ গদি-আঁটা চেয়ার থেকে শুরু করে মেঝের কার্পেট, সর্বত্র বইপত্রের স্তূপ। এক কোণে রাখা একটি কেটলি, শিগগিরই সেটির সদ্ব্যবহার হল। ক্রিসের সঙ্গে বসে শত শত কাপ চা খাওয়ার সেই শুরু। তাঁর উষ্ণ অভ্যর্থনা আমাকে খুব নাড়া দিয়েছিল। তথাকথিত কেমব্রিজ স্কুলের ইতিহাসবিদদের সম্বন্ধে ভারতে পণ্ডিতদের মধ্যে তখন এই ধারণা প্রচলিত ছিল যে তাঁরা অতি দুষ্ট প্রকৃতির। আমার মনে সেই ধারণা ওই সন্ধ্যায় ভেঙে গেল।

এর পর কেমব্রিজে ছ’টা আশ্চর্য বছর। প্রথম তিন বছর এরিক স্টোক্‌স ও ক্রিস বেয়্‌লির মহিমময় উপস্থিতিতে সেন্ট ক্যাথারিন ছিল সাম্রাজ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস চর্চার এক অতুলনীয় কেন্দ্র। এরিক ছিলেন আমার সুপারভাইজার। সুসান-এরও। ১৯৮১ সালে এরিকের অকালমৃত্যু কেমব্রিজে আমাদের সকলকে ভয়ঙ্কর আঘাত দিয়েছিল। এরিক সেন্ট ক্যাথারিন’স কলেজে একটি ফেলোশিপ-এর জন্য আমার নাম সুপারিশ করেছিলেন। আমি গবেষণা শেষ করলাম ক্রিসের কাছে, ১৯৮১ থেকে ’৮৪ পর্যন্ত কলেজের হাই টেব্‌ল-এ তাঁর সঙ্গী হয়ে। এরিক আরও গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করেছিলেন। সুসানকে ক্রিসের বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন। তার পরিণামে আমরা একটি আনন্দময় শুভবিবাহের সাক্ষী হতে পেরেছিলাম। তার অল্প দিন পরেই ঘন কুয়াশায় ঢাকা পার্কার্স পিস পেরিয়ে ১২ নম্বর সিটি রোড-এ গিয়েছিলাম বড়দিনের মধ্যাহ্নভোজে। সে কী এলাহি আয়োজন! খাওয়াদাওয়ার পরে টিভির সামনে বসে ক্রিস বুদ্ধিমানের মতো একটি চমত্‌কার ঘুম দিয়ে নিলেন, আমি আর সুসান বসে বসে কুরোসাওয়ার ‘দেরসু উজালা’ দেখলাম। অন্তহীন ছবি, তবে অসামান্য নিশ্চয়ই।

কেমব্রিজের কিছু কিছু ইতিহাসবিদ স্যর লুইস নেমিয়ার-এর ধারা অনুসরণ করে ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে আদর্শরহিত, গোষ্ঠীস্বার্থচালিত হিসেবে প্রতিপন্ন করে যে ইতিহাস রচনা করেছিলেন, সত্তরের দশকের শেষের দিকেই তার মহিমা অন্তর্হিত হয়, কিন্তু ইলাহাবাদের স্থানীয় ইতিহাস খুঁড়ে ক্রিস যে গবেষণা করেছিলেন, তার মূল্য কালজয়ী। এবং ক্রিস তত দিনে নতুন এক বড় কাজ হাতে নিয়েছেন। কেমব্রিজে তখন বিদ্যাচর্চার দারুণ পরিবেশ। ক্রিস বেকার তামিলনাড়ুর গ্রামাঞ্চল নিয়ে গবেষণারত, সুসান বেয়্‌লি সেন্টস, গডেসেস অ্যান্ড কিংস গ্রন্থের কাজ করছেন, আয়েশা জালাল লিখছেন দ্য সোল স্পোকসম্যান, বম্বের শ্রমিক নিয়ে গবেষণা করছেন রাজ চন্দ্রভারকর, আমি অ্যাগ্রারিয়ান বেঙ্গল-এর কাজ করছি। ক্রিস বেয়্‌লি এই সময় তাঁর ধ্রুপদী গ্রন্থ রুলারস, টাউনসমেন অ্যান্ড বাজারস লিখছেন, যে বই প্রকাশিত হল ১৯৮৩ সালে। এটা খুবই লক্ষণীয় যে, ভারতীয় সমাজকে এলিট এবং সাবঅলটার্ন-এ আড়াআড়ি ভাগ করে ইতিহাস রচনার নতুন উদ্যোগ ঘোষিত হওয়ার এক বছরের মধ্যে ক্রিসের বইটি প্রকাশিত হল, যে গ্রন্থ বিভিন্ন মধ্যবর্তী সামাজিক বর্গ এবং ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠায় তাদের ভূমিকার বহুমাত্রিক বিশ্লেষণে সমৃদ্ধ। ক্রিস তাঁর গবেষণায় বিভিন্ন পথ দেখিয়েছেন, কিন্তু আমি মনে করি, ১৭৭০ থেকে ১৮৭০ পর্যন্ত বিস্তৃত একশো বছরে ব্যবসায়ী, ব্যাঙ্কার এবং বৃত্তিজীবীদের সম্পর্কে এই কাজটিই তাঁর শ্রেষ্ঠ গবেষণা, যদিও এর দশ বছর পরে প্রকাশিত এম্পায়ার অ্যান্ড ইনফর্মেশন-এর দাবিও জোরদার। সপ্তদশ শতাব্দীতে সংগঠিত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলি কী ভাবে আঞ্চলিক রাজ্যগুলির সীমা অতিক্রম করে কারবার চালিয়েছিল, তার এমন গভীর বিশ্লেষণ আর কেউ করেননি।

রুলারস, টাউনসমেন অ্যান্ড বাজারস-এর প্রতি আমার অনুরাগের অবশ্য একটা বিশেষ কারণ আছে। এই বইয়ের গড়ে ওঠার পর্বটিতে এর নানান বিষয় নিয়ে ক্রিসের সঙ্গে আলোচনায় কেমব্রিজের পাবগুলিতে আমি অনেক সময় কাটিয়েছি, সেই সব আলোচনার মধ্য দিয়ে এই বইয়ের নানা অংশের বিবর্তন ঘটেছে। আর, এম্পায়ার অ্যান্ড ইনফর্মেশন-এর পাণ্ডুলিপি আমার কাছে এসেছে নিরুত্তাপ হরফে, আটলান্টিকের উল্টো দিকে বসে তা পড়েছি।

ক্রিস এই বইটি লিখেছেন আগের বইয়ের সূত্র ধরে, কিন্তু সে জন্য নতুন পথ কেটে নিয়েছেন তিনি। এখানে তিনি নির্মাণ করেছেন একটি ‘ইনফর্মেশন অর্ডার’ বা তথ্য-কাঠামোর নতুন ধারণা। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র কী ভাবে তথ্য সংগ্রহ করত এবং উত্তর ভারতের সমাজে তথ্য চলাচলের ধারাটি কেমন ছিল, সে বিষয়ে আলোচনা করেছেন তিনি। ক্রিস যখন এই গ্রন্থ লিখছেন, সেই সময় দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস চর্চায় কৌমভিত্তিক বিশ্লেষণের ধারাটি অতি প্রবল। তিনি কিন্তু দেখাচ্ছেন, ঔপনিবেশিক ভারতে সুশাসন এবং শাসকের নৈতিক স্বীকৃতি সম্পর্কে বিচার-বিশ্লেষণের চর্চা রীতিমত জোরদার ছিল, সমাজতাত্ত্বিক য়ুরগেন হাবারমাস যাকে ‘পাবলিক স্ফিয়ার’ বা জনপরিসর বলেছেন, তার প্রবল অস্তিত্ব ছিল। আগের বইটিতে ‘ঔপনিবেশিক অর্থনীতির দেশি উত্‌সসমূহ’ এবং পরের বইটিতে ‘উত্তর ভারতীয় জ্ঞানভাণ্ডার (একিউমেন)’ বিষয়ক অধ্যায়গুলি কোনও কোনও মহলের ভুল ব্যাখ্যার শিকার হয়: বলা হয় যে, ক্রিস নাকি প্রাক্-ঔপনিবেশিক এবং ঔপনিবেশিক শাসনের মধ্যে একটা ধারাবাহিকতা দেখিয়েছেন। ঘটনাটা ঠিক উল্টো। প্রকৃতপক্ষে, ক্রিস পরিবর্তনের পর্বগুলিকে ক্রিস অত্যন্ত সতর্ক ভাবে ভাগ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, আগে তথ্যকে দেখা হত জ্ঞানী ব্যক্তিদের নিজস্ব সম্পদ বা দক্ষতা হিসেবে, সেখান থেকে ঔপনিবেশিক যুগে এল ব্যক্তিনিরপেক্ষ তথ্যের ধারণা, মোটামুটি ১৮৩০ সালের মধ্যে এই পর্বান্তর ঘটে গেল। পরিসংখ্যানের ভাণ্ডার গড়ে তোলা হল। তথ্যের পরিমাণ এর ফলে বাড়ল বটে, কিন্তু প্রকৃত জ্ঞানী মানুষদের মর্যাদাহানি ঘটল, সেটা একটা গুণগত ক্ষতি। স্থান এবং কাল, দু’দিক থেকেই কী ভাবে এই পরিবর্তন ঘটেছিল, বেয়্‌লি সে বিষয়ে সচেতন ছিলেন। পঞ্জাব, নেপাল এবং বর্মার তুলনায় উত্তর ভারতের হৃদয়পুরে ইন্দো-ইসলামিক জনভূমি-র ধারণা ছিল খোলামেলা এবং সহজবোধ্য। যে পণ্ডিত তথা বিদ্যাজীবীরা ব্রিটিশ রাজের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন, হিন্দুস্তানের জ্ঞানী মানুষদের চিহ্নিত করতে গিয়ে ক্রিস হয়তো তাঁদের তুলনায় কোম্পানির সহযোগী মুনশিদের প্রতি কিঞ্চিত্‌ বেশি আনুকূল্য দেখিয়েছেন। কিন্তু জ্ঞান এবং তথ্য সংগ্রহের যে বিপুল ব্যর্থতার ইতিহাস তিনি উদ্ধার করেছেন, ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের কারণ অনুধাবনে তার গুরুত্ব বিস্তর।

সাম্রাজ্য এবং জাতিরাষ্ট্রের (নেশন) মধ্যে ধারণাগত যাত্রাপথ সন্ধান করতে গিয়ে বিশ শতকের শেষের দিকে ক্রিস বেয়্‌লি দুটি তাত্‌পর্যপূর্ণ বই লিখেছিলেন। উনিশ শতকের সূচনাপর্বে ওয়েলেসলি ও তাঁর সমকালীন রাজপুরুষরা ব্রিটেনের যে জাতীয়তাবাদী সাম্রাজ্যবাদের প্রতিভূ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন, সে বিষয়ে আলোকপাত করেছে ইম্পিরিয়াল মেরিডিয়ান বইটি। লিন্ডা কলি-র ব্রিটনস-এও এ ক্ষেত্রে ফরাসি বিপ্লব এবং নেপোলিয়নীয় যুগের তাত্‌পর্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে, কিন্তু সেই উত্তাল দশকগুলিতে কী ভাবে কেবল ‘ক্যাথলিক অপর’-এর বিপরীতে নয়, ‘ঔপনিবেশিক অপর’-এর বিপরীতেও ব্রিটিশ জাতীয় সত্তার ধারণাটি তৈরি হয়, ক্রিসের গবেষণা তার যুক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আবার, তাঁর ওরিজিনস অব ন্যাশনালিটি ইন সাউথ এশিয়া গ্রন্থটি ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে ‘ডেরিভেটিভ ডিসকোর্স’ রূপে ব্যাখ্যা করে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের এক সম্পূর্ণ নতুন মাত্রা যোগ করে। প্রাক্-ঔপনিবেশিক দেশপ্রেমের (পেট্রিয়টিজ্ম) বিভিন্ন রূপ সম্পর্কে তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টি আমাদের ঋদ্ধ করেছে, আমরা দেখেছি, কী ভাবে একটি দেশের সংজ্ঞা খুব বেশি কঠোর ভাবে নির্দিষ্ট না করেও কী ভাবে তার সঙ্গে তার অধিবাসীদের সম্পর্ককে দেশপ্রেম হিসেবে ভাবা হত। আঞ্চলিক বাসভূমিকে ভারতে সচরাচর ওয়তন বা দেশ নামে ডাকা হত, সেই স্বভূমির প্রতি ভালবাসার পিছনে এক দিকে কাজ করত মনের টান, ভক্তি-ধর্মের ভাষায় যা মূর্ত হত, অন্য দিকে থাকত সুশাসন ও শাসকের নৈতিক স্বীকৃতি সম্পর্কে যুক্তিবাদী নীতি। প্রাক্-ঔপনিবেশিক দেশপ্রেমের ধারণায় পরিসর (‘স্পেস’) একই সঙ্গে সীমায়িত এবং অসীম, আবদ্ধ এবং প্রসারিত। যেমন, হিন্দুস্তান বলতে উত্তর ভারতের গাঙ্গেয় সমভূমিকে বোঝাত, আবার গোটা উপমহাদেশকেও বোঝাতে পারত, যার পরিসর অ-নির্দিষ্ট। আধুনিক ভারতীয় জাতীয়তা কখনওই শুধুমাত্র ইউরোপীয় ধারণাকে অনুসরণ করে তৈরি হয়নি, এই প্রাক্-ঔপনিবেশিক দেশপ্রেমের উত্তরাধিকার থেকে মূল্যবান রসদ সংগ্রহ করেছে এবং একটা সৃষ্টিশীল উদ্ভাবনের নিরন্তর প্রক্রিয়ায় সেই উত্তরাধিকারকে সজীব রেখেছে।

একুশ শতকের প্রথম দশকে ক্রিস বিশ্ব ইতিহাস এবং বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের পারস্পরিক সম্পর্কের ইতিহাস নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি বেশ কিছু কাল যাবত্‌ বলছিলেন যে, দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসচর্চাকে উপমহাদেশের সীমান্ত অতিক্রম করে প্রসারিত হতে হবে। ১৯৯০ সালে আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত সাউথ এশিয়া অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড ক্যাপিটালিজ্ম গ্রন্থে ক্রিসের একটি প্রবন্ধ আছে: ‘বিটিং দ্য বাউন্ডারিজ’। তিনি লিখেছেন, ‘আঞ্চলিক ইতিহাসের ধারায় দক্ষিণ এশিয়াকে স্বতন্ত্র এবং নির্দিষ্ট একটি অঞ্চল হিসেবে দেখা হয়েছে, তুলনামূলক এবং সাধারণ প্রেক্ষিতে দেখা হয়নি।’ তিনি দক্ষিণ এশিয়া এবং মধ্য প্রাচ্যের একটি তুলনামূলক ও সংযোগভিত্তিক ইতিহাস রচনার পক্ষে জোরদার সওয়াল করেছেন। টিম হার্পারের সঙ্গে পেনাংয়ের ই অ্যান্ড ও হোটেলে লেখালিখির পক্ষে আদর্শ পরিবেশে বসে লেখা ফরগট্ন আর্মিজ এবং ফরগট্ন ওয়রস-এ ক্রিস আমাদের দেখিয়েছেন, এশিয়ায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবসানের দিনগুলিতে কলকাতা থেকে সিঙ্গাপুর অবধি বিস্তৃত বলয় কী বিপুল উচ্ছ্বাস এবং সুতীব্র অভিঘাতের শরিক হয়েছিল। এই দুটি গ্রন্থে এক রোমাঞ্চকর কাহিনির আকারে সে ইতিহাস ধরা আছে। এর আগে তিনি লিখেছেন উনিশ শতকের বিপুল ইতিহাস। বিশ্ব জুড়ে অভিন্নতা বেড়ে চলেছে, তাঁর এই প্রতিপাদ্য স্বভাবতই তর্ক তুলেছে, প্রতিবাদীরা বিভিন্নতা এবং স্বাতন্ত্র্যের উপর জোর দিয়েছেন।

২০০৭-এর জানুয়ারিতে নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো-র সুবর্ণজয়ন্তীতে ক্রিস বেয়্‌লি কলকাতায় নেতাজি স্মারক বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয়, আমার বাবার প্রজন্মের মানুষরা এখনও বুঝতেই পারতেন না, আমি আজ কী করে এখানে উপস্থিত হয়েছি।’ সে দিন সুভাষচন্দ্র বসু এবং আউং সান-এর তুলনামূলক আলোচনা করে তিনি এক অসাধারণ বক্তৃতা দিয়েছিলেন।

ইতিহাসবিদ হিসেবে ক্রিসের ব্যক্তিগত কৃতিত্ব বিরাট, তার পাশাপাশি ইতিহাস গবেষণার নতুন পথ দেখানোর প্রভূত সামর্থ্যও তাঁর ছিল। এক দিকে তিনি ভারতের অভ্যন্তরে বিভিন্ন আঞ্চলিক সত্তা গড়ে ওঠার ইতিহাস রচনায় পথ প্রদর্শন করেছেন, প্রেরণা দিয়েছেন, অন্য দিকে উপমহাদেশের ইতিহাসকে বৃহত্তর ভারত মহাসাগরীয় এলাকা এবং বিশ্বের প্রেক্ষিতে বিচারের প্রকল্পেও অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন তিনি। তৃতীয় একটি নতুন ধারাতেও গবেষণার পথ খুলে দিয়েছেন তিনি: বৌদ্ধিক চর্চা তথা নতুন ধারণার ইতিহাস। তিনি এ ক্ষেত্রেও তরুণ ছাত্র-গবেষকদের উপদেশ দিয়ে ক্ষান্ত হননি, নিজে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন। তাঁর রিকভারিং লিবার্টিজ আধুনিক দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে একটি বিশাল অবদান হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে।

আমার সৌভাগ্য, এ বছরের গোড়ার দিকেই বারাণসী এবং দিল্লিতে ক্রিসের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। ফেব্রুয়ারি মাসে লন্ডনের ফ্লাইট ধরতে বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে দিল্লিতে তাঁর সঙ্গে প্রাতরাশ করেছিলাম। ঠিক হয়েছিল, এই গ্রীষ্মে আবার আমাদের দেখা হবে। কিন্তু সেটা হওয়ার ছিল না। ক্রিস বেয়্‌লির মৃত্যুতে আমরা হারালাম ভারতীয় ইতিহাসচর্চার শ্রেষ্ঠ ব্রিটিশ পণ্ডিতকে, আধুনিক বিশ্ব ইতিহাসের এক অসামান্য বিশ্লেষককে এবং এক অনন্য শিক্ষককে, যিনি পরবর্তী প্রজন্মের ইতিহাসবিদদের প্রভূত প্রেরণা দিতে পারতেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE