Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

হামি তোমাকে মারবে

জেমস বন্ড-এর চুমু কেটেকুটে ভারতীয় সেন্সর বোর্ড আমাদের শেখালেন, কত ক্ষণের চুমু যথাযথ চুমু। কিন্তু ছোটখাটো সমস্যা ঠোঁটে উঠে আসছে।প্র থমত চুমু মাত্রেই অ্যাক্কেরে অবান্তর, অপ্রাসঙ্গিক, কারণ চুমু খেলে প্রজনন হয় না, তাই তার সামাজিক প্রয়োজন শূন্য, বিশ্বে গুচ্ছের ট্রাইব চুমুই খায় না কক্ষনও, আর কে না জানে ট্রাইবরাই সৎ ও আন্তরিক, ‘সভ্য’রাই বরং ধাস্টামোর জাসু, মিডিয়া থেকে ম্যানুয়াল টুকে প্রেম লড়িয়ে থাকে।

চন্দ্রিল ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৫ ০০:১৯
Share: Save:

প্র থমত চুমু মাত্রেই অ্যাক্কেরে অবান্তর, অপ্রাসঙ্গিক, কারণ চুমু খেলে প্রজনন হয় না, তাই তার সামাজিক প্রয়োজন শূন্য, বিশ্বে গুচ্ছের ট্রাইব চুমুই খায় না কক্ষনও, আর কে না জানে ট্রাইবরাই সৎ ও আন্তরিক, ‘সভ্য’রাই বরং ধাস্টামোর জাসু, মিডিয়া থেকে ম্যানুয়াল টুকে প্রেম লড়িয়ে থাকে। চুমু যে কোনও মহতোমহীয়ান ঘটনাই নয়, নিতান্ত পরিত্যাজ্য ইন্ট্রোবিশেষ, তার আঁটো প্রমাণ: শরীর অভ্যাস হয়ে গেলে, আদ্ধেক যুগল গোটা আদরের মানচিত্রে চুমুর ধারই ধারে না। সেই চুমুর দৈর্ঘ্য ছেঁটেছে বলে ভারতীয় সেন্সর বোর্ডের নামে সবাই যা-তা বলছে? জেমস বন্ড দুখানা চুমু খেয়েছিল, সেন্সর তার পঞ্চাশ পার্সেন্ট সু-সময় খাবলে দিয়েছে। বেশ করেছে। বন্ডের সিনেমায় তো এক কণা চুমুও থাকা উচিত নয়। ব্যাটা দুর্ধর্ষ স্পাই, ভয়ানক গোপন মিশনে যায় আর অহরহ রক্তাক্ত গ্যাঁড়াকলে জড়িয়ে পড়ে, তাকে খুন করার জন্যে ভিলেনরা হন্যে হয়ে তেরছা চোখে পিলপিলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কখন ছদ্মবেশী দারোয়ান আস্তিন থেকে হড়াৎ ভোজালি বের করবে বা মেনিবেড়াল জিভ থেকে ঝিকিয়ে দেবে মিনিবন্দুক, সে কিনা এই গেল-গেল ঝুঁকির হাওয়ায় নারীর সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে ওষ্ঠক্রীড়ায় ব্যস্ত থাকবে? এ তো ন্যারেটিভে ভুল! সেন্সর শুধু সুস্থ রুচির লুচিই ফোলায়নি, চিত্রনাট্যকারের গলদ শুধরে দিয়েছে। এই বোর্ডের হাতে থাকলে, বন্ড প্রথম দৃশ্যেই ব্রহ্মচর্য নিত, দ্বিতীয় সিন থেকেই টিকিতে টংকার দিয়ে হরবখত ইতিউতি প্যারানয়েড নজর হানত, যাতে সারভাইভাল কিছুতে বিঘ্নিত না হয় এবং দেশ ও দশের, বা বলা ভাল সাতের, মানে শূন্য শূন্য সাতের, কাজে সে এত্তটুকু অপচয়-না-হওয়া তাকত নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। আমেরিকার ঘেঁটি ধরে যে লজিক-শিক্ষে দিল, তাকেই কিনা আমরা ব্যঙ্গ করে ‘সংস্কারি জেমস বন্ড’-এর চরিত্র টুইটারে ফিট করছি, যে সুন্দরী দেখলে ভির্মি ও গোমূত্রের ককটেল খায়?

নিন্দুক জিগাচ্ছে, আচ্ছা, আমাদের সেন্সরপ্রধান কি আরএসএস? বিজেপি? ছি! বিজেপি ছাড়া কি কেউ চুমু-বিরোধী হতে পারে না? বা, কেউ কি আলাদা আলাদা কারণে বিজেপি এবং চুমুশত্রু হতে পারে না? হয়তো হিন্দুত্বের ধ্বজা ওড়াতে চায় বলে বিজেপি হল, আর প্রেমিকা লেঙ্গি মেরেছে বলে চুমুর ওপর খেরে গেল, সব্বাইকে ভ্যালেন্টাইনের দিন পিট্টি দিল! তা ছাড়া এ তো পবিত্র মেডিক্যাল ওয়ার্নিংও বটে। চুমু খেলে ক’লাখ ব্যাকটেরিয়া ভাইরাস এ-মুখ ছেড়ে ও-মুখে পাঁইপাঁই ট্যুর। শুধু পোলিয়োর বিরুদ্ধে চেতনা গড়লেই তো স্বাস্থ্যকর্তব্য শেষ হয়ে যায় না। হ্যাঁ, ঠিকই, এখন যিনি সেন্সর বোর্ডের মাথা, তিনি নির্বাচনের আগে ‘হর ঘর মোদী’ ক্যাম্পেনের মিউজিক ভিডিয়ো প্রযোজনা করেছিলেন, আর এখন ‘প্রেম রতম ধন পায়ো’-র ইন্টারভ্যালে কিছু হল-এ যে মিউজিক ভিডিয়োটা দেখানো হচ্ছে, যেখানে কখনও মোদী তুষারাবৃত গিরিচূড়ায় ধ্যানভঙ্গিতে গ্যাঁট, কখনও ওবামার সঙ্গে হ্যান্ডশেক-রত, পেছনে তারস্বরে মোদী-প্রশস্তির লিরিক ভক্তিতে হড়হড়, সেটা সেন্সরমোড়লই পরিচালনা করেছেন, নিজের টাকায় ও নিজের ইচ্ছেয়, কিন্তু তা বলেই তো আর তিনি বিজেপি হয়ে যান না! তা ছাড়া, সিধে কথা, এ দেশে সব দলই চুমুর বিরুদ্ধে। এখন বিজেপি কাতে পড়েছে বলে সিপিএম কিছু বলছে না, কিন্তু সেও এ সব ম্লেচ্ছ ছম্মকছাল্লু পছন্দ করে না। তৃণমূলও করে না, তবে বন্ডনারী নীল-সাদা লিপিস্টিক লাগালে ছাড় আছে।

এ বার আসলি সমস্যা। কতটা চুমু চালালে তবে প্যাশন পুরো হয়, কতটা ঠোঁট ছাড়ালে অশালীন? এ তো আমাদেরও জেনে রাখা উচিত, একা বন্ডবাবাজিই তলে তলে বন্ডিং করছেন, তা তো নয়। যে সরলাক্ষ ড্যাবারা ভাবছেন, কেন, ট্যাঁকে স্টপওয়াচ নিয়ে সিনেমাটা দেখলেই টপাটপ হিসেব হয়ে যাবে, তাঁদের জানাই, বন্ড দুটি দৃশ্যে দুটি আলাদা মেয়েকে চুমু খাচ্ছিলেন। নির্লজ্জ দুশ্চরিত্র বিদেশির চুমু-সময় আর ভারতের হোলসেল সৎ ও সতী পুং-স্ত্রী’র চুমু-টাইম নিশ্চয় এক হতে পারে না! তবে ভরসা: ভারতের মহাজ্যাঠাগণ চুম্বন কাণ্ডটা যখন অ্যালাও করেছেন, সেটা মাত্তর এক বা দু’সেকেন্ডে বেঁধে দেবেন না। ও তো নেহাতই ঠোকর। তিন সেকেন্ড চুমু খেলে শত্রু হবে। বরং দশ বেশ ভাল সংখ্যা। ওর মধ্যে একটা ফুলমার্কসের ব্যাপার আছে। কিন্তু কেউ যদি দশ সেকেন্ডের একটা চুমু খেয়ে, এক সেকেন্ড রেস্ট নিয়েই ফের দশ সেকেন্ড লাগু, এ ভাবে চালিয়ে যায়? তা হলে কি আইন করা উচিত: পাঁচ মিনিটের মধ্যে এক বার মাত্তর দশ সেকেন্ড বা তার কম সময় চুমু খাওয়া যাবে? কিন্তু আজকের যুগে ফেমিনিস্ট ফ্যাকড়া তো উঠবেই, মেয়েরা বলতে পারে, চুমুটা যদি ছেলেটি শুরু করে থাকে, দশ সেকেন্ড পরে ওই অধর-কানেকশনেই মেয়েটিকে ঠোঁট-ডমিনেট করতে দিতে হবে আরও অন্তত বিশ সেকেন্ড! এখানে আর একটা পয়েন্ট সেমিনারবাজদের জিভে অলরেডি সুলসুলোচ্ছে, চুমু যে শুধু বিপরীত লিঙ্গের মানুষের মধ্যে হবে তা কে বললে? ছেলে-ছেলে, মেয়ে-মেয়ে এবং ছেলে-মেয়ে: তিন প্রকারের চুমুরই কি একই দৈর্ঘ্যের অনুমতি দেওয়া হবে, মানে, ভারতীয় ল্যান্ডস্কেপে, যেথা পালোয়ানরা এই মুহূর্তে গোমাংস-ব্যান নিয়ে গলা ফাটাচ্ছে ও লাঠি টাটাচ্ছে? না, জনগণের ভোটের ব্যবস্থা করে লাভ নেই, সমকামীরা হেরে যাবে, ওদের হয়তো .০০৭ সেকেন্ড অ্যালাও করা হল মাত্তর।

আরও: পনেরো-ষোলোর মানুষের যে তীব্র প্যাশন ও শরীর-কৌতূহল, সাতাশ-আটাশের তা নয়। ষাট-সত্তরের আরও কম। তবে কি বয়স বাড়লে, প্রদত্ত সেকেন্ড কমবে? কিন্তু কেউ যদি প্রকৃত ভারতীয় জীবনযাপন করে থাকে, এবং তেত্তিরিশ বছর বয়সে প্রথম চুমুটা খায়, সম্বন্ধ করে বিয়ের পর আর কী, তাকে কেন অভিজ্ঞদের দণ্ড ভোগ করতে হবে? তার হয়তো চুমুর কথা ভাবলেই এদান্তি ভিসুভিয়াস জাগছে, এবং তা তো ভারতীয় আনুগত্য-কোডের শর্ত-সই। বুড়োরাও চেঁচাতে পারেন, এখন তাঁরা চুমু বই অন্যান্য দেহঘনিষ্ঠতা করতে পারছেন না, সবেধন সোহাগে তো বরং বেশি সময়ের লাইসেন্স দেওয়া উচিত। আরও: খুব বুড়োর সঙ্গে খুব ছুঁড়ির (বা ছোঁড়ার সঙ্গে বুড়ির) চুমু চললে, কার বরাদ্দ অনুযায়ী সেকেন্ড ক্যালকুলেট করা হবে? গ.সা.গু. করতে হবে কি?

যে ঘড়ি দেখতে পারে না, তার কী হবে? সে কি একটা লোক রাখবে, যে তক্কে তক্কে থাকবে, চুমু শুরু হলেই লাফিয়ে ‘ইয়োর টাইম স্টার্টস নাউ’ ও চিল্লিয়ে কাউন্টডাউন? শয্যামশারির পাশে এহেন উল্লম্ফনময় সময়বাবুর উসুখুসু চোখ, সেন্সরের ভারত-চেতনার সঙ্গে সমঞ্জস হবে কি? এই ঘড়িওয়ালার মাইনেই বা কে দেবে? রাষ্ট্র? চুমু-পোজিশনও গুরুত্বপূর্ণ। বসে, দাঁড়িয়ে, শুয়ে চুমু তো এক নয়। শুয়ে চুমু খেলে অন্যান্য খারাপ বাসনা জাগতে পারে বলে ওটা আধ সেকেন্ডে আটকে দেওয়া হোক। অবিশ্যি বসে চুমু খেয়ে তার পর শুয়ে পড়লে আলাদা। যার শ্বদাঁত বড় তার চুমুসময় কেটে দেওয়া হবে কি না, সে ড্রাকুলা-অনুশাসন প্রণয়নও জরুরি। খুব দাড়িগোঁফওলা লোককে চুমু খেলেও কেউ দ্রুত রেহাই চাইতে পারে, অত সুড়সুড়ি সয়ে কি প্রেম বজায় রাখা যায়? কিন্তু সে কথায় আবার বাঙালি ফায়ার: তার দুই স্তম্ভ, রবীন্দ্রনাথ ও মার্ক্সের চুম্বনজীবনকে হীন করা হল। সর্বোপরি, কোনও শয়তান যুগল যদি ময়দানে বা নিক্কো পার্কে আইন-বাড়তি লম্বু চুমু খায়, দর্শক কী বলে দুয়ো দেবে: ‘এ রাম!’, না, ‘কিস্-নো?’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE