দক্ষিণ কোরিয়ার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক বাড়িতে বসিয়া টেলিভিশন চ্যানেলকে সাক্ষাৎকার দিতেছিলেন, দুর্নীতির অভিযোগে দেশের রাষ্ট্রপতির অপসারণ বিষয়ে। গুরুগম্ভীর বিশ্লেষণের মধ্যেই অকস্মাৎ দেখা গেল, তাঁহার ঘরের দরজাটি খুলিয়া ঢুকিয়া পড়িল একটি চার বৎসরের বালিকা, নাচিতে নাচিতে। আসিয়া সটান দাঁড়াইয়া পড়িল কম্পিউটারের সম্মুখে, যাহার মাধ্যমে সাক্ষাৎকারটি প্রচারিত হইতেছে। বিব্রত বাবা তাহাকে ঠেলিয়া সরাইয়া দিতে চেষ্টা করিলেন, যাহাতে ক্যামেরায় তাহাকে দেখা না যায়, কিন্তু তৎক্ষণাৎ, প্রায় নাটকের ন্যায়, ঢুকিয়া পড়িল এক নয় মাসের শিশু, তাহার ‘বেবি ওয়াকার’টি চালাইয়া। এবং সাক্ষাৎকারের সর্বনাশ রুখিতে, পিছনে হুড়মুড় করিয়া ঢুকিয়া পড়িলেন এক মহিলা, তিনি শিশুদের টানিয়া লইয়া যাইতে চেষ্টা করিলেন ঘরের বাহিরে, কিন্তু বালিকাটি চিৎকার করিয়া আপত্তি জানাইতে লাগিল, শিশুটির ওয়াকার দরজায় আটকাইয়া যাইল। অবশেষে তাহাদের বাহির করিয়া, মহিলা দরজা টানিয়া দিলেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলিয়াছেন, তিনি ভাবিয়াছিলেন, ওই চ্যানেলে ওইটিই তাঁহার প্রদত্ত শেষ সাক্ষাৎকার, তিনি ফোন করিয়া ক্ষমাও চাহিয়া লন। কিন্তু অচিরেই ভিডিয়োটি ভাইরাল হইয়া যায়, একটি অকলুষ মজার ভিডিয়ো হিসাবে শুধু ফেসবুকেই ইহা দৃষ্ট হইয়াছে প্রায় সাড়ে আট কোটি বার, ভদ্রলোক তাঁহার ফোনটি ‘এয়ারপ্লেন মোড’-এ রাখিয়াছেন, অভিনন্দনের তোড় আর সহ্য করিতে পারিতেছেন না, সমগ্র পরিবার ইউটিউব তারকা হইয়া উঠিয়াছে। ঘটনাটি লইয়া প্রচুর ‘মিম’ও তৈয়ারি হইয়াছে।
বহু রকম মন্তব্য উড়িতেছে। কেহ বলিতেছে, ‘বাড়িতে থাকিয়া কাজ’-এর যে প্রচলন হইয়াছে, তাহা যে অফিসে কাজের বিকল্প হইতে পারে না, ইহা প্রমাণিত হইল। কেহ বলিতেছে, কোনও মহিলা যদি সাক্ষাৎকার িদতেন আর বাড়ির শিশুরা আসিয়া বিরক্ত করিত, তাঁহার স্বামী কি এমন দ্রুততায় তাহাদের সরাইয়া লইয়া যাইতেন? কেহ নিশ্চিত, অমন আপৎকালেও শিক্ষকটি যে তড়িঘড়ি উঠিয়া দাঁড়ান নাই, তাহার কারণ তিনি নির্ঘাত পায়জামা পরিয়া বসিয়াছিলেন, উপরে কোট আর নীচে ঘরোয়া পোশাক পরিয়া সাক্ষাৎকার দেওয়ার হাল ফ্যাশনের ইহাই বিপদ। কেহ বলিতেছেন, সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই ইচ্ছাকৃত ভাবে করা হইয়াছে, ইহার কোনও গভীর প্রতীকী অর্থ রহিয়াছে। অনেকের আপত্তি: ভদ্রলোক অমন রূঢ় ভাবে বালিকাটিকে সরাইয়া দিলেন, মহিলা ওই ভাবে উহাদের টানিয়া লইয়া যাইতেছিলেন, উঁহারা তাহা হইলে পরিবারে শিশুদের সহিত অমন ব্যবহার করেন?
সর্বাধিক আলোচনা হইতেছে অন্য এক বিষয় লইয়া। অধিকাংশ ফেসবুক বা টুইটার ব্যবহারকারীই এই ভিডিয়ো লইয়া মন্তব্য করিবার সময় ধরিয়াই লইয়াছেন, যে-মহিলাটিকে দেখা যাইল, তিনি শিশুদিগের আয়া। কারণ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী শ্বেতাঙ্গ, মহিলা কোরীয়। কিছু পরে যখন স্পষ্ট হয় মহিলা তাঁহার স্ত্রী, সঙ্গত কারণেই আলোচনা শুরু হয়: অধিকাংশ মানুষের ভিতরেই বর্ণবৈষম্য কি গভীরে প্রোথিত? এই সূত্রে এশীয় মহিলারা তাঁহাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা লিখিতে শুরু করেন, শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত দেশে তাঁহাদের মুখে সাবলীল ইংরাজি শুনিলে লোকে কেমন বিস্মিত হয়, বা তাঁহারা উচ্চ পদে চাকুরি করিলে কেমন অবিশ্বাসী দৃষ্টির সম্মুখে পড়েন। পথেঘাটে, গণশৌচাগারেও তাঁহারা বৈষম্যমূলক আচরণের সম্মুখীন হন। অনেকেই শ্বেতাঙ্গকে বিবাহ করিয়াছেন, তাঁহারা সপরিবারে বেড়াইতে যাইলে, এবং সন্তান শ্বেতাঙ্গের ন্যায়ই দেখিতে হইলে, অবধারিত ভাবে শপিং মলের অন্য মানুষেরা মহিলাকে সন্তানদের আয়াই ধরিয়া লন। স্কুলের অনুষ্ঠানে অন্য ছাত্রছাত্রীর মায়েরা তাঁহাদের এড়াইয়া কথা বলেন। মাত্র কয়েক দিন পূর্বে মার্কিন অভিনেতা কাল পেন (যাঁহার অভিভাবকদ্বয় অনাবাসী ভারতীয়) গত দশকে তাঁহার কয়েকটি অডিশনের চিত্রনাট্য সোশ্যাল নেটওয়ার্কে দিয়াছেন, যাহাতে দেখা যাইতেছে ‘এশীয়’ চরিত্রটির কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য হইল, তাহাকে গাঁধীর মতো দেখিতে হইতে হইবে, বা তাহার নাম হইতে হইবে প্রায় অনুচ্চার্য, বা তাহার সর্ব ক্ষণ ঘাম হইবে, বা ইংরাজি উচ্চারণ হইবে হাস্যকর ঝোঁকসম্পন্ন। যদিও ভিডিয়োটি বিষয়ে শিক্ষকের কোরীয় স্ত্রী বলিয়াছেন উহা হইতে কেবল মজাটুকুই লওয়া ভাল, এবং শিক্ষকের মা বলিয়াছেন এই কাহিনির একমাত্র নীতিবাক্য: ‘কাজে বসিবার সময় দরজা বন্ধ রাখিবে’, তবু শঙ্কা: এশীয়দের এই বেদনার আখ্যান এবং বর্ণদ্বেষের এই গতিযাত্রা দ্বার বন্ধ করিয়া রুখিয়া দেওয়া যাইবে কি?
যৎকিঞ্চিৎ
জগদীশ বসুকে সকলেই প্রণাম করে, কিন্তু কেউই মান্য করে না। সকলেই প্রাণপণে ছিঁড়ে নেয় ঘাস পাতা ফুল। কিন্তু এ বার ‘ফাইভ-জি’ প্রযুক্তি আসতে পারে জগদীশবাবুরই গবেষণার ওপর ভিত্তি করে। তাঁর ১৮৯৫-এ করা নিরীক্ষাই, বহু বিশেষজ্ঞের মতে, হয়ে উঠতে পারে নতুন যোগাযোগ-বিপ্লবের মেরুদণ্ড। তাতে যদি মোবাইল ফোন হয়ে ওঠে সুপার-ঝটিতি কেতাদুরস্ত, তখন তাঁকে উঠতে-বসতে শ্রদ্ধা না করে এ যুগ যাবে কোথায়? ‘জয় জগদীশ’ স্তব ভাইরাল না হয়ে যায়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy