রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা নিয়ে ভারত সরকারের অবস্থানে এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে দ্বিচারিতা। এক দিকে সুপ্রিম কোর্টে অ্যাফিডেভিট মারফত সরকার জানিয়েছে যে এ দেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মায়ানমার ফেরত পাঠানো হবে। অন্য দিকে, এই সে দিন বাংলাদেশে ভারতের হাই কমিশনার ঢাকায় জানিয়েছেন যে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ সারা বিশ্বকে অনুপ্রাণিত করেছে। উল্লেখ্য— সেখানের শরণার্থী শিবিরগুলিতে ভারত থেকে ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হচ্ছে মিশন ইনসানিয়ত-এর মাধ্যমে। জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি স্বাভাবিক ভাবেই লুফে নিয়েছে গেরুয়া শিবির; বিজয়া দশমীর বক্তৃতাতে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতও রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে কঠোর অবস্থান নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সরকারকে। তাতে গলা মিলিয়েছে সংবাদ মাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ার বড় একটি অংশ।
‘রিয়ালপলিটিক’-এর বোদ্ধারা স্মরণ করাচ্ছেন আসিয়ান গোষ্ঠীর সদস্য হিসাবে মায়ানমারকে চিনের দিকে ঠেলে দেবার বিপদ। উত্তর-পূর্ব ভারতের জনবিন্যাস বদলে যাওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন অনেকেই। কিন্তু একটি প্রশ্ন থেকেই যায়। এই সব যুক্তি কি মুছে ফেলতে পারে একটি মৌলিক কথা যে, রোহিঙ্গা মানুষজনের সবচেয়ে বড় পরিচয় এখন, তারা শরণার্থী, আশ্রয়প্রার্থী। আশ্রয়প্রার্থী এবং আশ্রয়দাতার মধ্যেকার সম্পর্ক নিরূপিত হয় যে নৈতিকতার নিরিখে, তার গুরুত্ব কি এই সব জটিল হিসেব নিকেশের চেয়ে এতটাই কম? হিসেব নিশ্চয়ই প্রয়োজনীয়, কিন্তু রাষ্ট্রের দিক থেকে শরণার্থীদের প্রতি মনোভাব কি রাষ্ট্রদর্শনের ভিত্তিতে যে নৈতিকতা, তাকে এড়িয়ে চলতে পারে?
চলতে যে পারে না, তা কিছুটা হলেও সম্প্রতি প্রমাণ করেছে ইউরোপ। মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা শরণার্থীদের ঢেউ সামলাতে নিজের অতীত নিংড়ে তুলে এনেছে নিরাশ্রয়কে শর্তহীন ভাবে আশ্রয় দেবার মহৎ সম্ভাবনাকে। এই সম্ভাবনা ইউরোপের একটি প্রাচীন ঐতিহ্য ও চর্চার সঙ্গে সম্পর্কিত। এক কথায় সেটিকে বলা যায়, cities of refuge বা আশ্রয়-শহর। আমরা অনেকেই জানি যে প্রাচীন এই প্রথার উৎস হল বাইবেল। ওল্ড টেস্টামেন্ট-এর বুক অব নাম্বার-এ ঈশ্বর মোজেসকে নির্দেশ দেন, ছয়টি শহর নির্মাণ করতে যেখানে আশ্রয় নিতে পারবেন অন্য প্রদেশ বা শহর থেকে আসা মানুষজন, যাদের প্রাণসংশয় হয়েছে নানাবিধ কারণে। চোখের বদলে চোখ, রক্তের বদলে রক্ত, এই কানুনের প্রয়োগ অন্যত্র থাকলেও এই সব শহর ছিল শরণার্থীদের নিরাপদ আশ্রয়। প্রাচীন গ্রিসেও আশ্রয়দানের এই প্রথা অনুসৃত হত। বিগত শতকের শেষ পর্বে যখন বহু লেখক, শিল্পী এবং দার্শনিকের ওপর নেমে এসেছিল ফতোয়া এবং হুমকির কুঠার, তখন এই cities of refuge-এর ধারণাটির বাস্তব প্রয়োগের চেষ্টা করা হয় ১৯৯৪ সালে স্ট্রাসবুর্গ শহরে। এর সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন জাক দেরিদার মতো চিন্তক, যিনি তাঁর বহু লেখায় নিঃশর্ত অভ্যর্থনা ও আশ্রয়দানের পক্ষে সওয়াল করেছেন। বাস্তব রাজনীতির বাধ্যবাধকতা সত্ত্বেও আশ্রয়প্রার্থী এবং আশ্রয়দাতার সম্পর্কের নৈতিকতাকে সম্মান জানিয়ে ইউরোপের অনেক দেশ যে ভাবে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা শরণার্থীদের আশ্রয় দেবার চেষ্টা করেছে, তা যেমন মানবতার নিরিখে প্রশংসনীয়, তেমনই ইউরোপীয় ইতিহাসের এই মহান ঐতিহ্যের প্রতি বিশ্বস্ততার পরিচায়ক।
ঐতিহ্যের প্রতি বিশ্বস্ততা। ঠিক এই জায়গাতেই রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রশ্নে ভারতের সরকারি অবস্থান নিয়ে আমাদের মনে সংশয় জাগছে। সনাতন ভারতবর্ষের ইতিহাস তো পরকে আপন করার এক নিরন্তর আখ্যান। চির কাল জাতি ধর্ম শত্রু মিত্র নির্বিশেষে সে ঠাঁই করে দিয়েছে অন্যকে। আলাদা করে cities of refuge নির্মাণ করার প্রয়োজন পড়েনি। কিন্তু বহু সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য এই দেশ হয়েছে চিরকালের আশ্রয়। ইরান থেকে আসা পার্সি সম্প্রদায়, জেরুজালেমের মন্দির ধ্বংসের পর আসা ইহুদির দল, আর্মেনিয়ান ব্যবসায়ী, সবার জন্যই ভারতবর্ষের দ্বার ছিল উন্মুক্ত, সবাই আশ্রয় পেয়েছে এই ভূমিতে। অনতি-অতীতেও এসেছেন সেই সব তিব্বতি মানুষজন, যাঁরা চিনের পিপলস লিবারেশন আর্মি দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে নিজভূমি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন ভারতের মাটিতে। আরও লক্ষণীয়, ভারতবর্ষে যে সব সম্প্রদায়ের মানুষ এসেছে যোদ্ধার বেশে, তারাও ফিরে যায়নি। শক, হূন, পাঠান, মোগল, সব লীন হয়েছে এই ভারতবর্ষেই। রবীন্দ্রনাথ বার বার ভারতের এই বৈশিষ্ট্যের দিকে আমাদের দৃষ্টি ফেরাতে চেয়েছেন, সেই ভারতবর্ষের দিকে, ‘পর বলিয়া’ যে ‘কাহাকেও দূর করে নাই’, ‘অনার্য বলিয়া’ যে ‘কাহাকেও বহিষ্কৃত করে নাই, অসংগত বলিয়া সে কিছুকেই উপহাস করে নাই।’ এই সনাতন ভারতবর্ষ ‘সমস্তই গ্রহণ করিয়াছে, সমস্তই স্বীকার করিয়াছে।’ অথচ আজকের ভারত প্রাণপণে অস্বীকার করে চলেছে নির্যাতিত মানুষের আশ্রয়ের প্রার্থনাকে। এই অস্বীকার আরও বেশি বিস্ময়ের উদ্রেক করে কারণ দেশ পরিচালনার ভার আজ যাদের হাতে তারা প্রতি মুহূর্তে দেশবাসীকে স্মরণ করান সনাতন ভারতবর্ষের ঐতিহ্যের কথা!
সনাতন ভারতবর্ষের জয়গান গাওয়া আজকের ভারত সরকারের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি যে আচরণ করছে, তা সেই ভারতবর্ষের আদর্শকেই ধুলায় লুটাচ্ছে। যে দেশ আশ্রয়প্রার্থীকে ফিরিয়ে দেয়, সে আসলে নিজ আত্মার সঙ্গে যোগ হারিয়ে ফেলা এক অতি সংকীর্ণ ভূমি। এই প্রক্রিয়াকে অমর্ত্য সেন বলেছেন miniaturization of India। এই ক্ষুদ্র সংকীর্ণ ভারতে আমাদের সুযোগ নেই ‘নর-দেবতারে’ নমস্কার জানাবার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy