Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

নীতির ইতি প্রভৃতি

নীতি আবার কী? মঙ্গলবারে যেটা নীতি, বেস্পতিবারে সেটাই দুর্নীতি। পরের সোমবার ফের সুনীতি। নীতি কি কচ্ছপ, উলটে দিলে আর সোজা হতে পারবে না? নীতিকে বরং নিজের মতো করে চেলে নিতে হবে, তাকে পোষা কুকুরের মতো এক বার ডাইনে এক বার বাঁয়ে চরাতে হবে। আরে বাবা, রাজনীতিতে নীতি কথাটা জুড়ে গেছে, সেটা একটা সমাপতন।

শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:০৫
Share: Save:

নীতি আবার কী? মঙ্গলবারে যেটা নীতি, বেস্পতিবারে সেটাই দুর্নীতি। পরের সোমবার ফের সুনীতি। নীতি কি কচ্ছপ, উলটে দিলে আর সোজা হতে পারবে না? নীতিকে বরং নিজের মতো করে চেলে নিতে হবে, তাকে পোষা কুকুরের মতো এক বার ডাইনে এক বার বাঁয়ে চরাতে হবে। আরে বাবা, রাজনীতিতে নীতি কথাটা জুড়ে গেছে, সেটা একটা সমাপতন। এই যদি পলিটিক্সের বাংলা হত ‘ঘনচক্কর’ কিংবা ‘দিকদারি’, ল্যাঠা চুকে যেত। কিন্তু আভিধানিকের খামখেয়ালে এক পৃথিবীর ভুলচুক হয়ে গেল। কেউ কিছু করলেই গাধাদের কাঁউকাঁউ কোশ্চেন: তোমার নীতি কোথায়? আরে নীতি খুঁজগে যা তোর পাড়ার কচুবনে। তা ছাড়া, নীতি বলে তো আসলে ভীরুতাকে চালিয়ে আসছিস অ্যাদ্দিন ধরে! অ্যাডভেঞ্চারের নাম শুনলেই তোদের পায়ের তলা সড়সড়ায়। ঝুঁকির কথা শুনলে, নতুনতার ধারণার চৌকাঠে এলে তলপেটে ওয়ার্নিং জাগে, বাথরুমের নিরিবিলি সেফ কোণে চলো ভাই। ঢুলতে থাকি, আর মুখস্থ বুলি আওড়াই। কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করলে নাকি বামপন্থীদের নীতি থাকে না। তাইলে গৌতম বুদ্ধের একটা বাণী শোন। যখন একটা লোকের গায়ে তির বিঁধেছে, তখন তার কোনটা প্রয়োজন— চিকিৎসা, না এই খুঁটিনাটিগুলো খতিয়ে দেখা: তিরটা কোত্থেকে এল, কে মারল, কেন মারল, সে জিন্‌স পরে ছিল না ঠোঁটে পিয়ার্সিং করিয়েছিল? মানে, শেষ দিকটা উনি বলেননি, কিন্তু ম্যাটারটা এটাই। যে মরতে বসেছে, সে ডাক্তারের হাত ভাল করে ধোওয়া কি না, তা বিচার না করেই ওষুধ গিলবে। বামপন্থী দলটাই যদি কাল বাদে পরশু উবে যায়, তা হলে আর নীতিসিদ্ধ বামপন্থা নিয়ে আমরা কী করব? ঘুগনিতে বেটে খাব?

তাও যে একেবারে নীতিকে জলে ভাসাচ্ছি, তা তো নয়। নীতিরও মাইক্রো-ম্যাক্রো আছে। ধরা যাক, একটা সরল প্রশ্ন, সিপিএম কী চায়? উত্তরটা সবাই জানে: জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব। এ কী, এত খকখক কাশি কেন? সকলে মুখে হাত চাপাই বা দিচ্ছে কেন? এটা কি নাট্যশালা? আরে, বাইরে থেকে বিচার করছিস কেন, বাইসেপে ট্যাটু থাকলে কি ব্রেনে সংস্কৃত শ্লোক থাকতে পারে না? মার্ক্সের দিব্যি, আমরা সব্বাই আসলে বিপ্লবের বিপবিপ। ব্যাপার হল, ক্ষমতায় থাকলে, বিপ্লব করা সহজ। তাই আমরা বিপ্লবের আগে, ক্ষমতা দখল করতে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। এ বার, ক্ষমতায় হেলান দিয়ে ডেঁটে বসে থাকতে গেলে, কিছু ঝামেলি করতেই হয়। একে দাবড়াও, ওর শিরদাঁড়া ভাঙো, তার বুকে বাঁশ ডলো। এগুলো মাইনর ব্যাপার। মা যেমন সন্তানের ভালর জন্যই তাকে ঠাটিয়ে চড় মারে। ও রকম দেখতে গেলে এই গোটা পৃথিবীতে একটাও লোক খুঁজে পাওয়া যাবে, যে কিনা প্রতিটি স্টেপে নীতি মাপছে? আর যদি মাপেও, তাকে আদৌ বুদ্ধিমান বলা যাবে কি? কারণ সে তো আসল উপাসনার চেয়ে, ভোরের শুচিবাই আর সন্ধের আহ্নিককে তোল্লাই দিচ্ছে বেশি। চৌরিচৌরায় এক পিস মাত্তর অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটল, আর তুমি গোটা মুভমেন্টটাকেই ঘ্যাঁচ ব্রেক কষে থামিয়ে দিলে, তার মানে তুমি দেশসুদ্ধু মানুষের সম্মিলিত উদ্দীপনাকে অপমান করলে, স্বাধীনতাকেও বিলম্বিত করলে, নিজের নীতি-ইগো’কে ডাঁশা গাজর খাওয়াবার জন্য।

মানেটা নিশ্চয় বুঝতে পারছিস। উপায় নয়, পরিণতিটা আসল। আমি যদি শেষমেশ খেলাটা জিতি, তা হলে আমার সবক’টা ফাউল সঙ্গত প্রমাণ হয়ে যায়। এই যে ভোটের আগে আমরা গুন্ডা আনতাম, ঘরে ঘরে তারা মাংসটাংস খেয়ে রাতটা থেকে গেল, পরের দিন রিগিং করে আমাদের জিতিয়ে দিল, কোনও গবেট ছোঁড়া তো জিজ্ঞেস করতে পারে, মা, গুন্ডাকাকুরা তো সাধারণ মানুষকে বেধড়ক পিটিয়ে পার্টিকে জেতাল, তা হলে আমরা অন্য পার্টির চেয়ে নিজেদের বেশি ন্যায়ঝোঁকা বলব কী করে? উত্তর হচ্ছে, শুধু ভোটের দিনের নীতি বিচার করতে গেলে, আমরা খারাপ। কিন্তু লং রান-টা দেখতে গেলে? আরে, আমরা েহরে গেলে যে বিপ্লব পিছিয়ে যাবে! প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাতে ক্ষমতার রাশ চলে গেলে, আমরা যে ভাল কাজগুলো করেছি, ড্রেনের জলে ভেসে যাবে। এটা ফোকাসে থাকলে, বুঝবি, ওই পরিস্থিতিতে রিগিংটাই সুনীতি। দূর অবধি দেখতে পাওয়ার মতো টেলিকোস্কোপিক তৃতীয় নেত্র না থাকলে, নীতি নিয়ে কথা বলা যায় না। ও ভাবে চললে হাঁটতেই পারবি না, কারণ পিঁপড়ে মাড়িয়ে দেওয়া নীতিবিরুদ্ধ।

কথা হল, তৃণমূলকে হারাতে হবে। তার জন্য এখন আমরা যা-ই করব, সেটাই সুনীতি। কারণ তা মানুষকে একটা অশিক্ষিত ঘুষখোর মস্তানিপ্রবণ জমানা থেকে মুক্তি দেবে। এটা কি একটা দল? ছিছিছি! এরা দক্ষ লোকের বদলে জরুরি পদে দলদাসদের বসাচ্ছে! শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের লোভ দেখিয়ে দলে টানছে! ভোটের সময় নিরীহ নাগরিকদের মারছে, আর বুথে নিজেদের লোক এনে কারসাজি করছে! এ সব এই বাংলায় কক্ষনও হয়েছে? আরে মমতার কোনও নীতি আছে? ও তো এক বার ভোটে জেতার জন্যে বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধেছিল! এ কি, কাশির শব্দ কেন? আরে বাবা, বিজেপির সঙ্গে জোট আর কংগ্রেসের সঙ্গে জোট এক হল? দেখছিস একটা সাম্প্রদায়িক দল আর একটা অসাম্প্রদায়িক দল, যতই মুখ্যু হোক না কেন। সারা জীবন কংগ্রেসকে যাচ্ছেতাই দল বলে, ইমার্জেন্সিকে ঘেন্না করে, ওদের আদর্শকে পুঁজিবাদ আর পিছনে-হটা’র আঁতুড় হিসেবে দাগিয়ে, আজ তার সঙ্গেই কোলাকুলি করে একশা হওয়াকে ভাবছিস নীতি-লংঘন? হাহা, অশিক্ষিত রে, পৃথিবীর ইতিহাসও পড়িসনি, ব্যাকরণও না। ওর নাম কৌশল। যদি কোনও মতে এক বার গদিতে আঁকড়েমাকড়ে বসতে পারি, তখন জোতদার-শোষক-দক্ষিণপন্থীদের দালাল কংগ্রেসকে লণ্ডভণ্ড ল্যাং মারার যে কৌশলটা আলিমুদ্দিনে ডিসকাস করব, সেইটা হচ্ছে নীতি।

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE