Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

জমি ঠিকা নেওয়া বৈধ হোক, তার শর্ত ঠিক করুন চাষিরাই

এত দিন স্রেফ মৌখিক চুক্তিতে অন্যের জমি চাষ করছেন চাষি। এ বার আইন বদলে জমির ঠিকা বৈধ করার সওয়াল জোরালো হচ্ছেভূমিসংস্কারের কাজটা করে দেখিয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব বরাবরই দাবি করে এসেছে বাঙালি। এ বার আর এক বাঙালি চাষের জমি ব্যবহারের শর্তে আমূল পরিবর্তনের প্রস্তাব আনলেন। নীতি আয়োগের কৃষিজমি লিজ সংক্রান্ত কমিটির চেয়ারম্যান, আদতে মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা তাজমুল হক প্রস্তাব করছেন, চাষের জমি ঠিকায় (লিজ) দেওয়া বৈধ করা হোক।

স্বাতী ভট্টাচার্য শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:১৮
Share: Save:

ভূমিসংস্কারের কাজটা করে দেখিয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব বরাবরই দাবি করে এসেছে বাঙালি। এ বার আর এক বাঙালি চাষের জমি ব্যবহারের শর্তে আমূল পরিবর্তনের প্রস্তাব আনলেন। নীতি আয়োগের কৃষিজমি লিজ সংক্রান্ত কমিটির চেয়ারম্যান, আদতে মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা তাজমুল হক প্রস্তাব করছেন, চাষের জমি ঠিকায় (লিজ) দেওয়া বৈধ করা হোক। যে ভাবে বাড়ি ভাড়া দেওয়া হয়, তেমন করেই ভাড়া দেওয়া হোক চাষের জমি। চাষিকে উৎখাত না করার, বংশানুক্রমে চাষ করতে দেওয়ার মতো শর্ত কেন চাপানো হবে জমির মালিকের উপর? কে, কী শর্তে জমি নেবে, কতদিনের জন্য নেবে, তা ঠিক করুন জমির মালিক আর চাষি। রাষ্ট্র শর্ত আরোপ করবে না।

কৃষি বিষয়টা রাজ্যের, এ নিয়ে আইন রাজ্যগুলিকেই করতে হবে। তবে সরকারি সূত্রে খবর, মোদী সরকার এ বিষয়ে এক ‘মডেল আইন’ করার কথা চিন্তা করছে। ভূমি সম্পদ মন্ত্রকে নীতি আয়োগের খসড়া জমা পড়বে। তা থেকে সংসদে পেশ পর্যন্ত যে লম্বা সফর, তাজমুল হকের প্রস্তাব কত দিনে তা পেরোতে পারবে, বলা কঠিন। কিন্তু প্রস্তাবের যে মূল কথাটা — চাষের জমি ঠিকা দেওয়া বৈধ করা — তা নিয়ে বিতর্ক একটা হওয়া দরকার। চাষ এখনও অধিকাংশ মানুষের, বিশেষত গরিব মানুষের জীবিকা। অথচ চাষ করে লাভ হচ্ছে না চাষির। বছরের পর বছর চাষ করেও চাষির বিপন্নতা কমছে না। চাষ ছাড়তে পারলেই যেন চাষি বেঁচে যায়। এমন চলতে পারে না। কিন্তু উপায় কই?

তাজমুল হক বলছেন, চাষের জমির ঠিকা বৈধ করাই সেই উপায়। দেশে অধিকাংশ চাষিই ছোট চাষি (ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি, যাঁদের জমি ২ হেক্টর, বা ১২ বিঘার কম)। এঁদের একটা মস্ত অংশ অন্যের থেকে কিছু জমি ঠিকা নিয়ে চাষ করছেন। কিন্তু বেশ কিছু রাজ্যে ঠিকা দেওয়াই বৈধ নয়। যে সব রাজ্যে বৈধ, সেখানেও ঠিকাচাষির স্বার্থরক্ষা করতে মালিকের উপর এমন নানা শর্ত চাপানো হয়, যে মালিক লেখাপড়া করে জমি দিতে রাজি হন না। না হলে হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে জমি ফেলে রেখে দেন। এতে ক্ষতি হয় ছোট চাষিরই।

প্রথমত, চাষ লাভজনক করতে হলে বেশি জমিতে চাষ করতে হবে ছোট চাষিকে। জমি হারানোর ভয়ে মালিক জমি ঠিকায় দিতে রাজি না হওয়ায় ছোট চাষি আরও জমিতে চাষের সুযোগ হারাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, বহু ছোট এবং প্রান্তিক চাষিও নিজেদের জমি ঠিকা দিতে চান, কিন্তু হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে দিতে পারেন না। ভবিষ্যতের কথা ভেবে ভূসম্পদ সুরক্ষিত রাখতে গিয়ে তাঁরা নগদ টাকা হারাচ্ছেন। ছোট বা মাঝারি জমি মালিকদের অনেকে গ্রাম ছেড়ে কাজের জন্যও যেতে পারেন না। জমির ওপর নজরদারির জন্য একজনকে থেকে যেতে হয়। অর্থাৎ তাঁর রোজগারের অন্য সুযোগ নষ্ট হচ্ছে। তৃতীয়ত, কোনও লেখাপড়া ছাড়াই ঠিকা নেওয়ার ফলে সেই জমি চাষ করার জন্য ঋণ পাচ্ছেন না চাষিরা। ফসল বিমা করাতে পারেন না। ফসল নষ্ট হলে সরকারি ক্ষতিপূরণ পান না।

জমির ঠিকা যদি বৈধ হয়, তা হলে এ সব সমস্যা এড়ানো যাবে, দাবি করছেন তাজমুল। যিনি ঠিকা নিয়ে চাষ করছেন, তাঁর জমির উপর অধিকার জন্মাবে না। তাই নিশ্চিন্ত মনে আরও বেশি মালিক তাঁদের জমি দেবেন ঠিকায়। বেশি জমি চাষের জন্য পাওয়া গেলে ছোট চাষিই উপকৃত হবেন। আর চাষিরা বৈধ উপায়ে ঠিকা পাওয়ার ফলে ঋণ, বিমা প্রভৃতি সুযোগ পাবেন। চড়া সুদে ঋণ নিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে আত্মহত্যার যে দুষ্টচক্র চলছে, তা থেকে মুক্তি মিলবে।

বড় চাষি, ছোট চাষি

প্রস্তাবটা শুনে খটকা লাগে এখানে যে, জমির মালিক এবং চাষি, দু’জনের জোর সমান বলে মনে করছেন তাজমুল। দু’পক্ষ দরদস্তুর করে পরস্পরের সুবিধে মতো একটা বোঝাপড়া করে নেবে, বাজারে যে কোনও দেনাপাওনায় যেমনটি হয়ে থাকে— এটাই ধরে নিচ্ছেন তিনি। কিন্তু কি তা মেনে নেওয়া চলে? সমাজে যার প্রভাব-প্রতিপত্তি বেশি, আইনকে সামনে রেখে সে-ই যে নিজের কাজ গুছিয়ে নেবে, এমনটাই হয়। তাই স্বাধীনতার পর নানা রাজ্যে চাষের জমির বিলিব্যবস্থা বিষয়ে যত আইন হয়েছিল, সেখানে জমি ঠিকা নেওয়া হয় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়, না হলে অতি কঠিন শর্ত চাপানো হয়। আইনপ্রণেতাদের ভয় ছিল, ঠিকা বৈধ করলে ফল হবে উল্টো। গায়ের জোরে ছোট চাষিদের জমি নিয়ে বড়রা চাষ করবে। বিকাশ রাওয়ালের মতো অনেক গবেষক দাবি করেছেন, কড়া আইন সত্ত্বেও তেমনটা যে হয়নি, তা নয়। পঞ্জাব, হরিয়ানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটকের মতো রাজ্যে বড় চাষিদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে জমির মস্ত অংশ। গবেষকদের অনেকে ঠিকার উপর কড়াকড়ি আলগা করার সওয়াল করেও বলছেন, কে ঠিকা নেবে, সে বিষয়ে কিছু বিধিনিষেধ থাকা দরকার। নইলে বড় চাষিরা জমির ঠিকার সুযোগ থেকে হঠিয়ে দেবে ছোটদের।

তাজমুল অবশ্য বলছেন, বড় চাষি বলে ভারতে কার্যত কিছু নেই। ‘‘পঞ্জাব-হরিয়ানাতেই বা বড় চাষি কোথায়?’’ প্রশ্ন তাঁর। জাতীয় নমুনা সমীক্ষার সাম্প্রতিক (৭০তম রাউন্ড) রিপোর্ট দেখাচ্ছে, পঞ্জাবে বড় চাষিদের (১০ হেক্টরের বেশি জমি) অধীনে রয়েছে ১২ শতাংশ জমি, হরিয়ানায় ৪ শতাংশ। গোটা দেশে বড় ও মাঝারি চাষিরা প্রায় ২৫ শতাংশ জমি নিয়ন্ত্রণ করেন। প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষিদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে অনেক বেশি জমি।

ছোট চাষির শোষণ-বঞ্চনার যে সাবেকি ছবি, সেখানে জমিদার ছিল ‘ভিলেন’, যে গফুর মিঞাকে নিজের জমিতে বেগার খাটায়, উপেনের দু’বিঘে জমি কেড়ে নেয়। ওই ছবিটা থেকে যে বেরিয়ে আসা দরকার, তা দশম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মাঝামাঝি সময়ের মূল্যায়নের রিপোর্টে (২০০৫) বলা হয়েছিল — ‘‘ছোটদের জমি বড়রা ঠিকা নেবে, এমন আশঙ্কার কোনও ভিত্তি নেই, যে হেতু প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষিরাই দেশের মোট ঠিকা-নেওয়া জমির ৮০ শতাংশ ঠিকা নিচ্ছেন।’’ ওই রিপোর্টের প্রস্তাব ছিল, ঠিকার উপর শর্ত না চাপিয়ে বরং জমির সীমা আইন বদলানো হোক, যাতে লিজ-নেওয়ার পরে চাষের মোট জমি ঊর্ধ্বসীমা না পেরোয়।

এখনও অবধি অবশ্য আইনি ছবিটা রয়ে গিয়েছে ষাট-সত্তরের দশকের মতোই, যখন ছোট চাষির স্বার্থরক্ষার জন্য প্রায় সব রাজ্য জমির ঠিকার উপর কড়াকড়ি করেছিল। কেরল, জম্মু-কাশ্মীরে ঠিকায় জমি দেওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তেলঙ্গানা, বিহার, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাঞ্চল, হিমাচল প্রদেশ, ওড়িশায় কেবল বিধবা, নাবালক, জওয়ানদের জমি ঠিকা দেওয়া চলে। অন্য রাজ্যগুলোয় ঠিকা অবৈধ না হলেও, ভাগচাষি বা ঠিকাচাষিকে ওঠানো দুঃসাধ্য। কোনও রাজ্যে ঠিকা-দেওয়া জমি বিক্রি করা যাবে না, তো কোথাও বলা হচ্ছে ওই জমি বিক্রি করতে হলে ঠিকা চাষিকেই বিক্রি করতে হবে। অন্ধ্র আর তামিলনাড়ুতে নিয়ম, মালিক ঠিকা-দেওয়া ফের চাষ করতে চাইলে অর্ধেকটা ফিরে পাবেন।

এই কড়াকড়িতে হিতে বিপরীত হয়েছে, বলছেন তাজমুল। তাঁর হিসেব, সেপ্টেম্বর ২০০৬ পর্যন্ত সব রাজ্য সরকার মিলে মোট ১ কোটি ৬৭ লক্ষ একর জমি তুলে দিয়েছেন দরিদ্র চাষির হাতে। সেই স্বত্ব হয় মালিকানা, না হলে চাষের অধিকারের (যেমন বর্গা)। কিন্তু কৃষিজমি হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে ওই একই সময়ে প্রচুর জমি মালিক ঠিকাচাষি, ভাগচাষিদের উৎখাত করেন। ফলে শেষ হিসেবে দেখা যাচ্ছে, ঠিকা চাষিদের মোট জমির চার শতাংশ দেওয়া গিয়েছে, কিন্তু তাদের উৎখাত করা হয়েছে ৩৩ শতাংশ জমি থেকে। অবস্থা বুঝে কোনও কোনও রাজ্য কিছু শর্তসাপেক্ষে ঠিকা ফের চালুও করেছে। কেরল যেমন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মেয়েদের জমি ঠিকা নিয়ে চাষ করাকে সমর্থন করছে।

কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ এই প্রস্তাব মেনে নেবে কি? স্বাধীনতার পর ছোট চাষিদের সুরক্ষা দেওয়া, তাদের হাতে জমি তুলে দেওয়ার জন্য ভূমি সংস্কারের আইন সব রাজ্যে হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু হাতে-গোনা কয়েকটি রাজ্যেই তার রূপায়ণ হয়েছে। তার একটা পশ্চিমবঙ্গ। ‘অপারেশন বর্গা’ করে রাজ্যের ৬০ শতাংশেরও বেশি ভাগচাষিকে নথিভূক্ত করেছিল এ রাজ্য। তাদের পুরুষানুক্রমে চাষ করার নিশ্চয়তা দিয়েছিল। জমি পুনর্বণ্টন করায় ২৪ লক্ষ চাষি জমির পাট্টা পেয়েছেন। ছোট চাষির জীবিকার সুরক্ষায় পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের এ কাজ বিশ্বের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে গিয়েছে। সে রাজ্যে ছোট চাষিকে ফের ঠিকা চাষের অনিশ্চয়তায় ঠেলে দেওয়া কেন জরুরি? কতটা জরুরি?

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE