Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

একটি ইট ও কিছু ভালবাসা

সন্ধেবেলায় না-হয় আইপিএল আছে, সকালে তো নেই। তা হলে সকাল কী করে কাটবে? সমস্ত টুইট খুঁজে দেখতে হবে, কোথায় কে আমাকে অপমান করেছে।

চন্দ্রিল ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৭ ০০:৩৯
Share: Save:

সন্ধেবেলায় না-হয় আইপিএল আছে, সকালে তো নেই। তা হলে সকাল কী করে কাটবে? সমস্ত টুইট খুঁজে দেখতে হবে, কোথায় কে আমাকে অপমান করেছে। সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে গাঁকগাঁক চেঁচাতে শুরু করতে হবে, ফেসবুকে তাকে অপমান করতে হবে, পালটা-টুইটে খ্যাঁকাতে হবে, তার বিরুদ্ধে অন্তত পঞ্চান্ন জনের মিছিল এক্ষুনি বেরোয় তার ব্যবস্থা দেখতে হবে। ঠিকই, এই গরমে সেটা শক্ত, রোদ্দুর পড়লে জনা আশি জোগাড় করে ক্ষতি ম্যানেজ করতে হবে। ধরা যাক, কেউ টুইট করেছে, ‘ধ্যাত্তেরি, রাস্তায় হাঁটার সময় একটা জঘন্য ইটে লেগে আমার পা কেটে গেল। মর হতভাগা ইট!’ অসম্ভব আপত্তিকর টুইট। ইট তো নিরীহ ভাবে রাস্তায় শুয়ে ছিল মাত্র। গত আড়াই হাজার বছর ধরে সে তা করে আসছে। অতএব এ তার ঐতিহ্য ও স্বাধীনতার অঙ্গ। টুইট-টা আসলে হওয়া উচিত ছিল, ‘রাস্তার একটা পবিত্র ও নিরপরাধ ইটে লেগে আমার পা কেটে গেল আমার জঘন্য অনবধানবশত পদচারণায়। মর আমার হতভাগা মনোযোগের অভাব ও ধ্যান প্র্যাকটিসে ফাঁকি।’

শুধু এটুকুই যথেষ্ট নয়, টুইটকারীর এটাও মাথায় রাখা উচিত ছিল, পা তো শুধু ইটে কেটে যায় না। পেরেকেও কাটে। তা হলে প্রকৃত পরিচ্ছন্ন টুইট-টা হবে: ‘যদিও রাস্তায় পড়ে থাকা পাথর, উঠে থাকা টিনের পাত, রেলিং-এর খচাং টুকরো, পিচে গেঁথে যাওয়া গাছের ডাল, বাচ্চার ফেলে দেওয়া পুতুলের ছুঁচলো অংশ, গড়াতে থাকা পেরেক, ফাঁক হয়ে যাওয়া জেম্‌স ক্লিপ, বোতলের ভাঙা কাচ, বেআক্কেলে কাঠের চোঁচ, কোল্ড ড্রিংকের তোবড়া ক্যান, খদ্দেরের হাত থেকে পড়ে যাওয়া ওয়ার্ক এডুকেশনের আলপিন এবং আরও ৩৩২৪ বস্তুতে পথিকের পা কেটে যেতে পারে, আমার আজ হাঁটতে গিয়ে পা কেটেছে একটা ইটের টুকরোয়। এটা নিতান্তই একটা নির্দিষ্ট ঘটনা, একটা বিশেষ মূহূর্তের ব্যাপার, তাই আলাদা করে ইটটাকে দোষ দেওয়ার কোনও প্রশ্নই উঠছে না, তবে কিনা, এই সমস্ত ধারালো জিনিসের রাস্তায় পড়ে থাকার আগে একটু বিবেচনা করা উচিত, নিজেদের গাঁতিয়ে জাহির করতে গিয়ে তারা অন্যের ক্ষতির কারণ হচ্ছে না তো? আফটার অল আমার তো নিজের মনে ভাবতে ভাবতে হেঁটে যাওয়ার অধিকার আছে, টেটভ্যাকে টাকা খরচা করতে না চাওয়ার অধিকার আছে। অবশ্য সেটা পথের মাঝমধ্যিখানে ইট-বাবাজির বুক চিতিয়ে শুয়ে থাকার অধিকারের চেয়ে বড় এ কথা কক্ষনও দাপিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছি না, কাউকে আঘাত দেওয়ার এতটুকু ইচ্ছে আমার নেই, তবে করজোড়ে মিনতি করছি, এ রকম একটা মতামত বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে, এগুলো না পড়ে থাকলে আমাদের হাঁটাহাঁটি হয়তো একটু নিরুদ্বেগ ও মসৃণতর হত।’ এতে অবশ্য টুইটার তার বার্তাটা নিত না (ক্যারেক্টারের সংখ্যা ১৪১ ছাড়াচ্ছে), সে নয় ফেসবুকে দিত। টুইট করাটা তো বড় কথা নয়, কাজটা ঠিক করে করাটাই বড়।

আরও পড়ুন:তবে তো শশীবাবুতেও হ্রস্ব ই-কার দেওয়া দরকার

অবশ্য সে কাজ ঠিক করে করলে আমি আমার কাজ করতে পারতাম না। আমার কাজ হল, শর্টে, ভালবাসা। ভালবাসা মানে কী? আমার ভাইকে যদি ভালবাসি, আর সে যদি মিনিবাস থেকে বাইক-আরোহীর টাকে থুতু ফেলে, আমি কি তাকে বাহবা দেব না? বাইকের লোক প্রতিবাদ করলে তার গায়ে ফ্রেশ থুতু ছুড়ব না? যা-ই ঘটুক, আমি তোমার পক্ষে— এই নিঃশর্ত আনুগত্যই কি ভালবাসাবাসি নয়? তা হলে, আমি যদি ইটকে ভালবাসি, আর ইটের নিন্দে করে কেউ টুইট করে, তুরন্ত অপমানিত বোধ করে তার মাথাটা ফট্টাস ফাটিয়ে দেওয়াই তো আমার ভালবাসার ঠোস-জোশ পরিচয়।

আমার মতো হাজারটা লোক পিলপিলিয়ে ঘুরছে, কেউ রুমালকে ভালবাসে, কেউ ডিমকে, কেউ পেঙ্গুইন পাখির নামে একটা বাঁকা টীকা শুনলেই রে-রে ঝাঁপাবে। আমরা সবাই ঘুম থেকে উঠেই টুইট, হোয়াট্‌সঅ্যাপ, গান, প্রবন্ধ, ঠোঙা, প্রেম-চিরকুট আতিপাতি স্ক্যান করি, কোথায় প্রিয়তম জিনিসের নামে এক পিস তেরছা স্মাইলি হানা হয়েছে, ব্যস, হালুম! ফতোয়া জারি করো, বা মুন্ডু খসাও, বা হুলিয়ে দেশছাড়া করো। আমরা চাই পৃথিবীকে ভালবাসায় ভরিয়ে দিতে।

যাকে ভালবাসি, তার কোনও খুঁতের সম্ভাবনা তো স্বীকার করব না-ই, তার নিন্দে যে আদৌ করা যায়: এই ধারণাটার অস্তিত্বই পৃথিবী থেকে মুছে দেব— এই আমাদের প্রেমল অ্যাজেন্ডা। তাই এমন রাঙা চক্ষু নিয়ে ঘুরি, রেগুলার অ্যায়সা অশান্তি পাকাই, যুক্তিগ্যাঁড়া থেকে আবেগন্যাড়া, সব্বাই আমায় দেখলে সিঁটিয়ে গিয়ে চল্লিশ গুণ খতিয়ে কথা বলে, পাছে ইষ্ট বলতে ইষ্টক বেরিয়ে পড়ে। ইটের নামে কেউ নালিশ হানলেই চিল্লাই, ঝামার নামে বললে না কেন? কিংবা বাঁশের? তখুনি প্রসঙ্গ গুলিয়ে যায়, টার্গেট-নালিশটা থেকে নজর ঘুরিয়ে দিতে পারি। যেন বাঁশ কুকাজ করলে ইটেরও কুকাজ করার অধিকার থাকে। বা, পৃথিবীর সব বেনিয়ম-স্মোকার তাদের সিগারেট ফেললে তবেই আমি আমার হাতের সিগারেটটা ফেলব, তার আগে অবধি ফকফক করে হাসপাতালের রোগীর মুখে ধোঁয়া ছাড়ব। সে দিন দূরে নেই, হোঁচট খেলে লোকে ইটকে ‘সরি’ বলে, টুইট করবে, ‘কী ভাগ্যি আজ তাঁর স্পর্শে আমার নশ্বর পা থেঁতলে গেল!’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Twitter Love
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE