Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

স্থিতাবস্থার প্রথম পাঠ, সমানে চলেছে

শিশুশিক্ষা, বর্ণপরিচয়, এমনকী সহজপাঠ— বাংলা প্রাইমারে প্রাচীন মূল্যবোধগুলির সেই দাপট থেকে আমরা আজও মুক্তি পেলাম না। হয়তো পাওয়ার কথাও নয়, কারণ সমাজের মনটা দেড়শো বছরেও পালটায়নি।শিশুশিক্ষা, বর্ণপরিচয়, এমনকী সহজপাঠ— বাংলা প্রাইমারে প্রাচীন মূল্যবোধগুলির সেই দাপট থেকে আমরা আজও মুক্তি পেলাম না। হয়তো পাওয়ার কথাও নয়, কারণ সমাজের মনটা দেড়শো বছরেও পালটায়নি।

শারদ্বত মান্না
শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:৩৮
Share: Save:

এমন পাখি তো কাজে লাগে না, অথচ বনের ফল খাইয়া রাজহাটে ফলের বাজারে লোকসান ঘটায়।’ ‘কাজে লাগা’ এবং ‘বাজার’ অর্থাৎ ‘ইউটিলিটি’ ও ‘মার্কেট’-এর সমস্যা সমাধানেই যে বাংলা ভাষায় প্রাইমারের আবির্ভাব, বর্ণপরিচয়ের ১৬০ বছর পর এ বিষয়ে আর সন্দেহের অবকাশ নেই।

পুরনো গ্রামীণ জীবনে শুভঙ্করীর আর্যা, জমির মাপজোক, সুদ কষা সহ পাটিগণিত, শ্লোক-পুথিপাঠ— সব মিলিয়ে এক ধরনের গুরুমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু ছিল। বিদেশি মিশনারিরাই প্রথম ধর্মপ্রচারের জন্য স্কুল বসান এবং সেখানে শিক্ষার জন্য প্রাইমারের প্রচলন করেন, কোনও বাঙালি নন। বিভিন্ন স্কুল ও পাঠশালায় নিজস্ব প্রাইমার ছিল। ১৮১৬ সালে শ্রীরামপুর মিশনের ‘লিপিধারা’ প্রথম প্রাইমার। এর পর স্কুল বুক সোসাইটি-র ‘বর্ণমালা’ রচনা করেন স্টুয়ার্ট। ১৮৩৫-এ প্রকাশিত ঈশ্বরচন্দ্র বসুর ‘শব্দসার’ প্রথম বাঙালির লেখা প্রাইমার। হিন্দু কলেজ পাঠশালার ‘শিশুসেবধি’ আর তত্ত্ববোধিনী পাঠশালার (নতুন) ‘বর্ণমালা’ প্রচলিত হলেও সর্বজনীন প্রাইমার ছিল না। প্রথম সর্বজনীন এবং জনপ্রিয় প্রাইমার লিখেছিলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার। ‘শিশুশিক্ষা’ প্রাইমার সিরিজের পাঁচটি ভাগের প্রথম তিনটি ভাগ তাঁরই লেখা। পরে এই তিনটি ভাগই ‘শিশুশিক্ষা’ নামে প্রচলিত হয়। চতুর্থ ভাগ লেখেন বিদ্যাসাগর, পরে ‘বোধোদয়’ নামে আমরা যাকে চিনি। পঞ্চম ভাগ ‘নীতিবোধ’ লেখেন রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

ব্যঞ্জনধ্বনির আগে স্বরধ্বনির প্রথাবিরুদ্ধ অবস্থান, বহু অপ্রচলিত যুক্তাক্ষরের বিলোপ— এ সব দিক দিয়ে শিশুশিক্ষা অভিনব। ‘পাখি সব করে রব, রাতি পোহাইল’ কিংবা ‘লেখাপড়া করে যেই,/ গাড়িঘোড়া চড়ে সেই’ আজ কমবেশি সবার ঠোঁটস্থ হলেও ‘শিশুশিক্ষা’ বইটার নাম জাতির স্মৃতি থেকে বেপাত্তা। অসামান্য জনপ্রিয় এই বইটির প্রথম প্রকাশের ছয় বছর পর ১৮৫৫ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত হয় বর্ণপরিচয়, বাকিটা ইতিহাস।

‘শিশুশিক্ষা’র ভাষা কাব্যময়, পাশাপাশি ‘বর্ণপরিচয়’ নিখাদ গদ্যে লেখা, যুক্তিনিষ্ঠ, নির্মেদ। বর্ণপরিচয়েই ‘দীর্ঘ ঋ’, ‘দীর্ঘ ৯’কে স্বরবর্ণ থেকে বাদ দিলেন বিদ্যাসাগর। ‘ং‌’ (অং) ও ‘ঃ’ (অঃ) ধ্বনি দু’টিকে স্বরধ্বনি থেকে ব্যঞ্জনধ্বনিতে পাঠালেন। তাঁরই হাতে বাংলা বর্ণমালার আধুনিকীকরণ ঘটে। উনিশ শতকে প্রগতিশীলতার বিস্ময়কর নজির ‘বর্ণপরিচয়’। সেখানে ধর্মের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উপস্থিতি নেই। অন্যান্য বহু প্রাইমারের মতো গ্রন্থের শুরুতে সরস্বতী বন্দনা নেই। এবং ছিল ব্যক্তি বিদ্যাসাগরের ব্র্যান্ড ভ্যালু। তাঁর ‘বর্ণপরিচয়’ মদনমোহনের ‘শিশুশিক্ষা’র চেয়ে জনপ্রিয় হবে, তাঁর জীবৎকালেই তার ১৫০তম সংস্করণ প্রকাশিত হবে সে আর বেশি কথা কী।

এর পরে ক্রমে বাংলায় প্রাইমার একটা ব্যবসা হয়ে উঠল। শিশুশিক্ষার কপিরাইট উঠে গেলে মদনমোহনের জামাই যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ তা ছাপতে শুরু করলেন। এর পর বিভিন্ন প্রেস থেকে ১৮৯৫-এ ১৬১তম, আর ১৮৯৬-এ ১৫৮তম সংস্করণ প্রকাশ হওয়া শুরু হল। ১৮৯৮-এ ১৫৬১তম সংস্করণও দেখা গেল। এক জন তো মদনমোহন তর্কালঙ্কারের লেখা শিশুশিক্ষা-র ‘চতুর্থ খণ্ড’ বার করে ফেললেন! এ দিকে বিদ্যাসাগরের জীবদ্দশাতেই তাঁর নামে বর্ণপরিচয় বার করে লেখা হল ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর/ মহাশয়ের চরণকমল স্মরণ করিয়া প্রণীত’। দ্বিতীয় লাইনটা এত ছোট করে লেখা যে চোখেই পড়ে না। এ সব আসল-নকল মিলিয়ে উনিশ শতকে কমবেশি পাঁচশো প্রাইমার প্রকাশিত হয়েছিল।

১৯৩০ সালে জন্ম নিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সহজপাঠ’। যে শিক্ষাব্যবস্থা প্রথাগত ছাত্র তৈরির যন্ত্রমাত্র, তার প্রতি অনীহা থেকেই রবীন্দ্রনাথের এই বৈপ্লবিক প্রয়াস। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে। বর্ণপরিচয়ে ২৩৯টি ক্রিয়ারূপের মধ্যে ‘পড়া’র ক্রিয়ারূপ ২৫টি। আর ‘সহজপাঠ’-এর প্রথম দুই ভাগে ‘পড়া’র উল্লেখ আছে মাত্র তিন বার। শিশুর জগতে যে কৌতূহল, ঔৎসুক্য আর নতুন দেখার চোখ, সহজপাঠ সেই চোখ দিয়েই পৃথিবীকে দেখায়। এই প্রাইমারে কোনও গুরুজন কোনও শিশুকে বলে দিচ্ছেন না— এটা করবে, ওটা করবে না; বলে দিচ্ছেন না— এটা না করলে শাস্তি হবে, ওটা করলে শাস্তি হবে। বরং বন্ধুর মতো, শিশু পাঠকের সমবয়সি এক শিশু কথক গল্প করে শিশুর সঙ্গে। সেই গল্পে থাকে চিত্রের বর্ণনা, সেই চিত্র কাব্যময়। প্রসঙ্গত, বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, ‘যে বয়সে ক-খ চিনলেই যথেষ্ট, সেই বয়সেই সাহিত্যরসে দীক্ষা দেয় ‘সহজপাঠ’, এই একটি বইয়ের জন্য বাঙালি
শিশুর ভাগ্যকে জগতের ঈর্ষাযোগ্য বলে মনে করি।’

জর্জ কারলিন নামের এক আমেরিকান কমেডিয়ান তাঁর শেষ বয়সের একটা শো-তে বলেছিলেন, শিশুকে পড়তে শেখানো কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। যার শেখার, সে নিজে নিজেই শিখে যাবে। বরং শিশুকে প্রশ্ন করতে শেখানো উচিত। যা সে পড়ছে, দেখছে, শুনছে, তার সব কিছুকেই প্রশ্ন করতে শেখানো উচিত। প্রাইমারের সুবিধা এখানেই। জ্ঞানভাণ্ডারে প্রবেশের মুখেই কোনও মনকে যদি আংশিক জড়, আংশিক পক্ষপাতদুষ্ট করে দেওয়া হয়, তাতে সিস্টেমের সাময়িক লাভ। পিতা-মাতা এবং গুরুমহাশয়কে শৈশবে মান্য করে চলতে শিখলে সেই শিশুই ভবিষ্যতে সমাজব্যবস্থাকে মান্য করে চলবে এবং টিকিয়ে রাখবে। বর্ণপরিচয়ের গোপাল-রাখালের তর্ক তো সুবিদিত।

উনিশ শতকের সমস্ত প্রাইমার ঘোরতর পুরুষতান্ত্রিকও। সে সময়ে ছাত্রের তুলনায় ছাত্রীর সংখ্যা কম ছিল, এ যুক্তি ধোপে টেকে না। কারণ, শিশুশিক্ষা বইটিতে নামের পরের লাইনেই লেখা আছে ‘এতদ্দেশীয় বালিকা বিদ্যালয়ের ব্যবহারার্থ’। বইয়ের তৃতীয় ভাগে ‘সুশীল বালক বালিকা সকলকে সমান ভাল বাসে’ এই নামে যে গদ্যটি আছে, কেবল মাত্র সেখানেই ‘সামা’ ও ‘বামা’ নামের দু’টি মেয়ের কথা পাওয়া যায়, আর কোথাও কোনও বালিকা নেই। মেয়ে দু’টির গুণের মধ্যে আছে তাদের পরস্পরের ভাব, উঁচুগলায় কথা-না বলা, সবসময় একসঙ্গে থাকা, পরিচ্ছন্ন থাকা, দাসদাসীকে কটু কথা না বলা, ভাগ করে খাওয়া। কী আশ্চর্য! ‘এতদ্দেশীয় বালিকা বিদ্যালয়ের ব্যবহারার্থ’ যে বইয়ের সৃষ্টি, সে বইয়ে বালিকাদের শিক্ষার উল্লেখমাত্র নেই! হয়তো সে কারণেই ‘ইহাদের পিতামাতা কত সুখী’!

গল্প এখানে শেষ হয় না। ১৮৫৮ সালে মদনমোহন মারা যাওয়ার পর ‘শিশুশিক্ষা’র তৃতীয় ভাগের পনেরোশো সংস্করণে শিশুশিক্ষার সেই গদ্যাংশের নাম হয় ‘সুশীল বালক সকলকে সমান ভাল বাসে’— ‘বালিকা’ শব্দটি উধাও, যেমন আজ উধাও পাঁচ কোটি মেয়ে, ভারতের জনসংখ্যা থেকে! শুধু তা-ই নয়, ‘সামা’ ও ‘বামা’ যথাক্রমে হয়ে যায় ‘রাম ঘোষাল’ ও ‘শ্যাম ঘোষাল’!

সমাজব্যবস্থার এই কাঠামোই অটুট রাখে ‘সহজপাঠ’ও। সেই সহজপাঠ, যেখানে দেখা যায় শিশু কথককে! ‘সহজপাঠ’-এর শিশু পাঠক পড়ার ভয় পায় না, গুরুমহাশয়ের বেতের ভয় পায় না। শৈশবে রবীন্দ্রনাথ যা-যা পেতে চাইতেন, তার ইচ্ছেপূরণ ঘটেছে। কিন্তু তার পাশাপাশি খুব সূক্ষ্ম ভাবে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিবৈষম্যকে স্বাভাবিক, সঙ্গত এবং প্রকৃতির মতোই চিরন্তন বলে দেখানো হয়েছে। সেখানে ‘দাসী’ ও ‘মালি’ কাজ করেই যায়, যেমন ভাবে ‘পাখি বনে গান গায়, মাছ জলে খেলা করে।’ সহজপাঠে ‘ভৃত্য’-কে কাজের ফরমান দেওয়া যায়, ‘ধোপা’-কে তার জীবিকার কারণেই নাম ধরে ডাকা যায় বয়সোচিত সম্মান না দিয়েই, সমবয়সি দরিদ্রকে ‘তুই’ সম্বোধনও করা যায়— এ সবই বড় স্বাভাবিক, সঙ্গত, চিরন্তন। পড়তে পড়তে প্রশ্ন জাগে, এই শিশু কি তবে ঠাকুরবাড়ির এক শিশু, কোনও সর্বজনীন শিশু নয়?

আজ, এই এত বছরে শ্রেণিনির্ভর সমাজ কিছুটা পুনর্বিন্যস্ত হয়েছে বটে, কিন্তু বৈষম্যের ধারণাগুলি বদলায়নি, বহিরঙ্গে যতই বদল ঘটুক না কেন। এর পাশাপাশি, বিদ্যাসাগরের পর বাংলা বর্ণমালার উল্লেখযোগ্য ও সর্বজনমান্য সংস্কার এখনও পর্যন্ত ঘটেনি। এ দিকে, ক্রমশ বিশ্বের বাজারে পিছু হটছে বাংলা ভাষা, বাংলা ভাষা নিয়ে চিন্তিত মানুষের সংখ্যা কমছে। বাড়ছে কেবল ‘ইউটিলিটি’ আর ‘মার্কেট’-এর গুরুত্ব, বিশ্বায়নের বাজারে এখন তা তুঙ্গে। শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা সম্বন্ধে কোনও জাতির মনোভাবের সূচক হিসেবে যদি প্রাইমারকে ধরা হয়, তা হলে বলতেই হয়, গত দু’শো বছরে সেই মনোভাবের কোনও বদল হয়নি। অথচ বদলটা প্রত্যাশিত ছিল।

‘পাখিটার শিক্ষা পুরা হইয়াছে।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE