সূ র্যস্নানের একটি অভ্যাস শ্বেতাঙ্গদের রহিয়াছে। সমুদ্রসৈকত পাইলেই তাঁহারা কখনও উলঙ্গ হইয়া ও কখনও নামমাত্র বস্ত্রখণ্ড জড়াইয়া শুইয়া পড়েন, যাহাতে রৌদ্র তাঁহাদের দেহকে সেঁকিয়া দিয়া যায়। রৌদ্রপ্রধান দেশের লোকেদের ইহা দেখিয়া চমক জাগিতে পারে, কিন্তু বহু পাশ্চাত্য দেশেই রৌদ্র এক বিরল বস্তু, উন্মোচিত গাত্রে থাকিবার ন্যায় উষ্ণ আবহাওয়াও বিরল বস্তু, তাই এই দুইটি একত্রে কোথাও পাইলে তাঁহাদের আহ্লাদের সীমা থাকে না এবং তাঁহারা মহানন্দে চিত ও উপুড় হইয়া সূর্যানন্দ উপভোগ করিতে থাকেন। এই অভ্যাস দেখিয়া কাহারও চক্ষু ললাটে উঠিয়া যায়, কাহারও পুলক জাগে, কেহ তাহার দর্শকাম পূরণ করিয়া লয়, কেহ বিকিনি-র ব্যবসায় পত্তন করে, কিন্তু সাধারণত কাহারও মনে উদিত হয় না: ইহা এক বর্ণবৈষম্যবিরোধী অভ্যাস ও সুতরাং ইহার সযত্ন লালন ও বিজ্ঞাপন প্রয়োজন। সত্যই, শ্বেতাঙ্গ মানুষের রৌদ্রবাসনার এক বিশেষ কারণ হইল, তাঁহারা নিজ ত্বককে কি়ঞ্চিৎ কৃষ্ণবর্ণ করিতে চাহেন, অন্তত বাদামি, এবং এই ভাবে গাত্রটিকে ‘ট্যান’ করিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতে অত্যন্ত ভালবাসেন। ফটফটে শ্বেত অঙ্গে বাদামি ছোপ ধরিলে বহু ললনা পার্টিতে খোলামেলা পোশাক পরিয়া তাহা সগৌরবে প্রদর্শন করেন এবং অন্যরা ‘অহো, কী ট্যান!’ বলিয়া প্রশস্তি করিতে থাকেন। মুশকিল হইল, সূর্যে নিজেকে অধিক উন্মুক্ত করিলে এই দেশগুলির লোকের ত্বক-ক্যানসারের সম্ভাবনা বাড়িয়া যায়। ফ্যাশনদুরস্ত হইতে গিয়া ক্যানসারগ্রস্ত হওয়া সুবিধার কথা নহে। তাই দশ বৎসর পূর্বে একটি গবেষণা শুরু হইয়াছিল, এমন কোনও ক্রিম বা লোশন আবিষ্কার করা যায় কি না, যাহা মাখিলে ত্বক আপনিই ট্যান হইয়া যায়, সূর্যের শরণ লইতে হয় না। এই সপ্তাহে একটি মার্কিন পত্রিকা মারফত জানা যাইল, গবেষণা সফল হইয়াছে, ইঁদুরদের উপর প্রাথমিক পরীক্ষা করিয়া দেখা গিয়াছে, লাল ইঁদুররা এই ক্রিম মাখিয়া কুষ্টিকালো হইয়া যাইতেছে, প্রায় এক সপ্তাহ পরে ধীরে ধীরে তাহাদের প্রকৃত গাত্ররং ফিরিয়া পাইতেছে। এই বার শ্বেতাঙ্গ ট্যান-প্রত্যাশীরা সূর্যের অপেক্ষায় না থাকিয়া, অনায়াসে নিজ গৃহেই ক্রিম মাখিয়া কার্য হাসিল করিতে পারিবেন। বিকিনির খরচাও বাঁচিয়া যাইবে।
শুনিয়া ভারতের লোকের চৌষট্টি বার ডিগবাজি খাইয়া মূর্ছা যাওয়া স্বাভাবিক, কারণ এখানকার বাদামি মানুষেরা প্রাণপণ ক্রিম মাখিতেছেন ফরসা হইবার লোভে। এই ধরনের ক্রিমের এই দেশে কোটি কোটি টাকার ব্যবসায় ও ক্রমশ চাহিদা ঊর্ধ্বমুখী। ভারতে কৃষ্ণকে পূজা করা হয়, মহাকালীরও প্রতিপত্তি রহিয়াছে, কিন্তু বাস্তবে কৃষ্ণবর্ণের অত্যন্ত অনাদর। বিশেষত কৃষ্ণা মেয়েদের কুরূপা বলিয়া ধরিয়াই লওয়া হয়। বিবাহের বিজ্ঞাপনে, এমনকী প্রেমের পছন্দের সময়েও, পুরুষের মন সাধারণত গৌরাঙ্গীর দিকেই ঝুঁকিয়া থাকে, ও এই ধারণার সমর্থনে নারীদের হৃদয় ও মস্তকও ঘটরঘটর নড়িতে থাকে। সফল হিন্দি গানের বাণী লক্ষ করিলে দেখা যাইবে, প্রেয়সীর গৌরবর্ণ লইয়া পুরুষের লম্ফ থামিতে চাহিতেছে না। যদিও এ কথা বারংবার প্রচার করা হইয়াছে যে কোনও ক্রিম ব্যবহারে মোটেও নিত্য গৌরবর্ণ আয়ত্ত করা সম্ভব নহে, তবু এই দেশে কেহ কোনও ধারণাকে পূজা করিতে শুরু করিলে, সহস্র নিবন্ধ বা জাঠা দিয়া তাহাকে নিরস্ত করা যায় না। কালো বলিয়া এই দেশে বিবাহের বাজারে মেয়ের মূল্য কমিয়া যায় ও অধিক পণ দিয়া তাহাকে পার করিতে হয়। তাই এই ক্রিম অনেকের নিকট সামাজিক সম্মানের চাবিকাঠি, এমনকী আর্থিক সর্বনাশ হইতেও বাঁচিবার প্রধান ত্রাতা।
ইহা কি তবে বিধাতার আশ্চর্য পরিহাস যে প্রাচ্যের মানুষ ফরসা হইবার লোভে ক্রিম মাখিতেছেন, আর পাশ্চাত্যের মানুষ কালো হইবার আকাঙ্ক্ষায় ক্রিম মাখিতে শুরু করিবেন? নদীর এ-পার এবং ও-পারের বিপরীত-আকাঙ্ক্ষায় সাঁইসাঁই দীর্ঘশ্বাস ফেলিবার ঘনঘটা কি তবে আক্ষরিক চিত্রনাট্য ধরিয়া বিকশিত হইবে? গৌরবর্ণের প্রতি ভারতের এই প্রবল আকর্ষণ কি আসিয়াছে শ্বেতাঙ্গদের অধীনে বহু বৎসর কাটাইবার ফলে? শাসককে নিশ্চিত শ্রেষ্ঠ ভাবিবার অভ্যাস হইতেই তাহার অনুরূপ বর্ণ পাইবার বাসনা? তাহা সত্য হইলে, একদা-শাসকেরা এবং তাহাদের ভ্রাতা-ভগিনীগণ কালো হইবার ক্রিম আবিষ্কার করিতে প্রবল অর্থ ব্যয় করিয়াছেন ও তাহার ফল লইয়া আহ্লাদে নাচিতেছেন দেখিলে হয়তো প্রাচ্যের বোধোদয় হইবে। তবে তখন প্রাচ্যের ফরসারা ওই কৃষ্ণ-ক্রিমের জন্য মাথা কুটিলে, বিপদ!
যৎকিঞ্চিত
জনি ডেপ হাসির ছলে বললেন (পরে ক্ষমা চেয়েছেন), ট্রাম্পকে খুন করা উচিত। ম্যাডোনা বলেছিলেন, হোয়াইট হাউস বোম মেরে ওড়াতে চান। র্যাপ-শিল্পী স্নুপ ডগ মিউজিক ভিডিয়োয় খেলনা পিস্তল তাক করেছেন ট্রাম্প-সদৃশ চরিত্রের দিকে। ট্রাম্পের অসভ্য কথাগুলোর চেয়ে এগুলো কোনও অংশে কম অসভ্য নয়। আসলে নিজেকে প্রতিষ্ঠানবিরোধী ভাবলেই এমন অহং-ফাঁপা ভোঁ লেগে যায়, শিষ্টতা ও সৌজন্য জানলা গলে ধাঁ। অশিক্ষা তবে আধুনিক বিপ্লবের ট্রাম্প-কার্ড?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy