কাশ্মীরে নিহত পুলিশ অফিসার মহম্মদ আয়ুব পণ্ডিত (ইনসেটে)। ছবি: সংগৃহীত।
দেশের দু’টি অঙ্গরাজ্যে দু’টি পৃথক ঘটনা। আঙ্গিকও সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু বীভৎসতায় তারা পরস্পরের সমগোত্রীয়। সহনাগরিকদের মধ্যে বিদ্বেষ, শত্রুভাবাপন্নতা, পারস্পরিক ঘৃণা ঠিক কোন মাত্রা স্পর্শ করলে দেশের প্রান্তে প্রান্তে এমন ঘটনা ঘটতে শুরু করে, সে কথা ভেবে আজ শিউরে উঠতে হচ্ছে। জম্মু-কাশ্মীর আর হরিয়ানা আজ মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত নামাচ্ছে।
পদস্থ পুলিশকর্তার নির্মম-নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী হল কাশ্মীর। আর রেল-যাত্রী কিশোরকে ভয়ঙ্কর গণপ্রহারের সামনে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়তে দেখল হরিয়ানা। কাশ্মীরে যে মসজিদের পাশে পুলিশকর্তা টহল দিচ্ছিলেন, সে মসজিদ রমজানের নমাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। আর হরিয়ানায় যে ট্রেনের কামরায় কিশোর যাত্রী মারণ আক্রমণের শিকার হল, সে ট্রেন আর পাঁচটা সাধারণ ট্রেনের মতোই নিরাপদে, নিরুপদ্রবে যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে উপত্যকার একাংশের যে তীব্র ক্ষোভ-ক্রোধ তাকে আচমকা উস্কে দিয়ে পুলিশকর্তাকে খুন করে দেওয়া হল। আর ট্রেনের কামরায় শুরু হওয়া এক সাধারণ বচসায় হঠাৎ চড়া সাম্প্রদায়িক রং লাগিয়ে দিয়ে কিশোর যাত্রীর হত্যা নিশ্চিত করা হল। অমানবিকতার আঁধার মনের ভিতরে কতটা জমাট বাঁধলে এমন সব ঘটনা ঘটতে পারে, ভাবলে আতঙ্কিত হতে হয়।
চলতি হাওয়ার একটা বড় অংশে যে আজ ঘৃণা আর বিদ্বেষের বিষ, সে কথা গোটা ভারত উপলব্ধি করছে। কিন্তু, শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে এ বিষ কতটা ক্ষতিকর, সে উপলব্ধি আসছে না কিছুতেই। বরং বিষের প্রবাহেই গা ভাসাচ্ছেন অনেকে রোজ নতুন করে। আরও গা়ঢ় হচ্ছে গরল, অলক্ষ্যেই আরও নীল হয়ে উঠছে বাতাস। আমরা কি এই পথেই এগোব? এই প্রবণতাই কি ধীরে ধীরে গ্রাস করে নেবে সমগ্র ভারতকে? হিংসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা, হানাহানি আর প্রাণনাশ কি আমাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠবে? সভ্যতা যা কিছু শিখিয়েছিল, যা কিছু অমূল্য উপহার দিয়েছিল— শান্তি, সুস্থিতি, সহাবস্থান, সৌহার্দ্য, সৌভ্রাতৃত্ব, সামাজিক আদান-প্রদান— সে সব কি এ বার জলাঞ্জলি দিয়ে দেব? প্রশ্নগুলোর কোনও সদুত্তর নেই। কারণ প্রশ্নগুলো যাঁদের উদ্দেশে, তাঁরা আজ বিষে উন্মত্ত, এ সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মতো মানসিক স্থিতি আজ নেই তাঁদের।
সামাজিক এই বিষ কিন্তু নতুন আসেনি। এ গরল ছিলই। কিন্তু সভ্যতার শিক্ষা তাকে অকেজো করে রেখেছিল। রাজনৈতিক সঙ্কীর্ণতার এক সাধনা সম্প্রতি শক্তিশালী করে তুলল সামাজিক বিষটাকে।
কাশ্মীরে বা হরিয়ানায় যা ঘটল, স্বাভাবিক মানস কিন্তু তা সহ্য করতে পারছে না। ঘটনাগুলো আমাদের সাংঘাতিক ভাবে নাড়া দিচ্ছে। নাড়া দিচ্ছে সুদীর্ঘ-লালিত ভারতীয়ত্বের ধারণাকেও। কিন্তু এর নিরাময় খুব সহজ কাজ নয়। সম্প্রীতি আর সহাবস্থানের পোশাকি বার্তাগুলোয় আর কাজ হবে না। শিকড় থেকে উপড়ে ফেলতে হবে বিষবৃক্ষকে। সে দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে, শাসককে নিতে হবে, বিরোধীকে নিতে হবে, ভারতীয় সমাজের প্রতিটি দায়িত্বশীল অংশকে নিতে হবে। প্রত্যেক নাগরিককেও ব্যক্তিগত ভাবে দায়বদ্ধ হতে হবে। অখণ্ড ভারতের জন্যই এ দায়বদ্ধতা জরুরি আজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy