Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

কর্তব্য?

বাবুলের আপত্তিটিতে, স্পষ্টতই, নূতন কোনও কথা নাই। শিবসেনার ন্যায় সংগঠন এই যুক্তিতেই গুলাম আলির অনুষ্ঠান বন্ধ করিয়া দেয়, পাকিস্তানি লেখকের পুস্তক প্রকাশের অনুষ্ঠান পণ্ড করিতে উদ্যত হয়।

শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:০৩
Share: Save:

সন্ন্যাসী হইলে নাকি পূর্বাশ্রম সম্পূর্ণ বিস্মৃত হইতে হয়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়াকে সন্ন্যাস গ্রহণের সঙ্গে তুলনা করা মুশকিল। কিন্তু, বাবুল সুপ্রিয়কে দেখিয়া সংশয় হয়, তিনি বুঝি পূর্বাশ্রম ভুলিয়াছেন। তাঁহার গায়কসত্তাকে ভুলিয়াছেন, শিল্পীর ধর্ম ভুলিয়াছেন। এখন তিনি শুধুমাত্র বিজেপির মন্ত্রী। শিল্পীর ধর্মের সহিত উগ্র জাতীয়তাবাদীর ধর্মের সংঘাত উপস্থিত হইলে তিনি কোন পক্ষ লইবেন, সেই উত্তর তিনি দ্ব্যর্থহীন ভঙ্গিতে জানাইয়া দিয়াছেন। বলিউডের ছবিতে পাকিস্তানি গায়কদের উপস্থিতিতে আপত্তি জানাইয়া তিনি বলিয়াছেন, দেশের প্রতি বলিউডের কর্তব্য আছে। যে পাকিস্তানি শিল্পীরা কখনও কোনও সন্ত্রাসবাদী হামলার নিন্দা করেন নাই, তাঁহাদের বাদ দিয়া ভারতীয় শিল্পীদের লওয়ার মাধ্যমে বলিউডকে সেই কর্তব্য সম্পাদন করিতে হইবে। বিজেপির রাজনীতিতে যে গতিতে বাবুলের উত্থান ঘটিয়াছে, তাহাতে তাঁহার রাজনৈতিক কাণ্ডজ্ঞান বিষয়ে কোনও প্রশ্নের অবকাশ নাই। কিন্তু, তিনি তো শুধু রাজনীতিক নহেন, ভূতপূর্ব শিল্পীও। তাঁহার গলায় কখনও তিন সপ্তক খেলুক বা না-ই খেলুক, সুরের সাধনা তো তিনিও করিয়াছিলেন। শিল্পীকে যে ভৌগোলিক সীমানায় আবদ্ধ করা যায় না, এই সহজ সত্যটি কি রাজনীতি তাঁহাকে ভুলাইয়া দিল?

বাবুলের আপত্তিটিতে, স্পষ্টতই, নূতন কোনও কথা নাই। শিবসেনার ন্যায় সংগঠন এই যুক্তিতেই গুলাম আলির অনুষ্ঠান বন্ধ করিয়া দেয়, পাকিস্তানি লেখকের পুস্তক প্রকাশের অনুষ্ঠান পণ্ড করিতে উদ্যত হয়। উগ্র জাতীয়তার বাজার সম্ভবত খানিক ধাক্কা খাইয়াছে— হাজার হউক, নীরব মোদী-কাণ্ডের যাবতীয় প্রশ্ন ও সমালোচনার উত্তরে নরেন্দ্র মোদী এখনও সিয়াচেনের সীমান্তে যুদ্ধরত সৈনিকদের কথা স্মরণ করাইয়া দেন নাই— তবুও, বাবুল নিরাপদ বাজি ধরিয়াছেন। এই জমানায় পাকিস্তানকে এক হাত লইবার কোনও মার নাই। প্রশ্ন শুধু তাঁহার শিল্পীসত্তা লইয়া। শিল্পীর কাজ যে শুধু নিজের শিল্পের প্রতি আদ্যন্ত সৎ থাকা, সন্ত্রাসবাদী হামলায় প্রতিক্রিয়া জানাইতে বাধ্য থাকা নহে— এই কথাটি বাবুল ভুলিয়াছেন। সম্ভবত স্বেচ্ছায়। ভারতে সন্ত্রাসী কার্যকলাপে কোনও দেশের কিছু নাগরিকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা থাকে বলিয়াই যে সেই দেশটিকে শত্রু ঠাওরাইতে নাই, এবং কোনও দেশ যদি শত্রু হয়ও, তাহার নাগরিকদের সহিত শত্রুতা থাকিতে পারে না— এই কথাগুলিও বাবুলকে স্মরণ করাইয়া দিতে হইতেছে। এবং, তাহার পরও তিনি মানিতে নারাজ। নাগপুরের হাওয়ার ক্ষমতা অনস্বীকার্য।

প্রশ্ন বলিউডের ‘কর্তব্য’ বিষয়েও। শিল্পের, অথবা শিল্পীর কি রাষ্ট্রের প্রতি কোনও কর্তব্য থাকিতে পারে? প্রশ্নটি যদি ভূতপূর্ব সোভিয়েট ইউনিয়নে উচ্চারিত হইত, তাহার ইতিবাচক উত্তর মিলিত। কিন্তু, একটি উদারপন্থী রাষ্ট্র কি ব্যক্তিপরিসরে রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্যপালনের দাবি করিতে পারে? এবং, সেই ‘কর্তব্যে’র চরিত্রই বা কী? ক্ষমতাসীন দল যে দেশটিকে ‘শত্রু’ বোধ করে, তাহাকেই শত্রু হিসাবে গণ্য করা কি কোনও নাগরিকের ‘কর্তব্য’ হইতে পারে? শিল্পের স্বাধীনতা, রুচির অধিকার অথবা বাণিজ্যিক বিবেচনাকে ছাপাইয়া যাইতে পারে এই ‘কর্তব্য’? বাবুল সুপ্রিয়ের নিকট এই প্রশ্নগুলির উত্তর মিলিবে, সেই সম্ভাবনা কম। নাগপুরের হাওয়া উগ্রতার শিক্ষা দেয়, যুক্তির অনুশীলনের নহে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Babul Supriyo Artists Pakistani Singers
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE