নিয়ন্ত্রক: বিচারপতি রাজেন্দ্র মল লোঢা
ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে রওনা হয়ে গেল ভারতীয় দল। তবে, আসল খবর বিরাট কোহালি বনাম অনিল কুম্বলের দ্বৈরথ, এবং শেষ অবধি কুম্বলের সরে দাঁড়ানো। চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে পরাজয়ও ঢাকা পড়ে গেছে সেই বিতর্কের ঝড়ে। তবে, বিতর্ক আরও আছে। চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ভারত আদৌ খেলবে কি না, সংশয় ছিল তা নিয়েই। লাভের ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে পছন্দসই সিদ্ধান্ত না হওয়ায় বিসিসিআই চ্যাম্পিয়নস ট্রফি বয়কট করার হুমকি দিচ্ছিল। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বিসিসিআই-এর মাথায় যে পর্যবেক্ষক কমিটি বসেছে, তার সঙ্গে বোর্ডের বিরোধ চলছেই। চ্যাম্পিয়নস ট্রফি নিয়ে তৈরি হওয়া অচলাবস্থাও সেই বিরোধেরই ফল। প্রশ্ন হল, আদালত কেন আদৌ বিসিসিআই-এর কাজে হস্তক্ষেপ করল? ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের পরিসরটিকে কি গণপরিসর আখ্যা দেওয়া চলে, যেখানে সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন হবে? ঘটনাক্রমে, এই প্রশ্নগুলো নিয়ে তেমন কোনও আলোচনা হয়নি।
১৯২৭ সালে প্রতিষ্ঠা ইস্তক বিসিসিআই বেসরকারি সংস্থা— সোসাইটিজ রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট-এর অধীনে নথিভুক্ত। তার পর থেকে দেশে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা ক্রমে বেড়েছে। খেলাটির দিকে নজরও বেড়েছে। কিন্তু, বিসিসিআই যে বেসরকারি সংস্থা, তা নিয়ে কার্যত কোনও বিতর্ক তৈরি হয়নি। প্রথম বার জট বাঁধল টেলিভিশনে ‘লাইভ’ খেলা দেখানো আরম্ভ হওয়ার পর। ১৯৯৩ সালে ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গল (সিএবি)-র হীরকজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত হল হিরো কাপ। সেই খেলা প্রদর্শনের অধিকার কার, তা নিয়ে বিসিসিআই আর সিএবি-র সঙ্গে দূরদর্শনের বিবাদ চরমে উঠল। সিএবি একটি বেসরকারি চ্যানেলকে খেলা দেখানোর স্বত্ব বিক্রি করল। কিন্তু কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক খেলার লাইভ সম্প্রচার করার অনুমতি দিতে অস্বীকার করল। মামলা গড়াল আদালতে। ১৯৯৫ সালে আদালত রায় দিল, তথ্য আদানপ্রদানের অধিকার বাক্স্বাধীনতার অংশ।
সেই রায়েই আদালত বিসিসিআই ও তার সদস্য সংস্থাগুলি বিষয়ে এমন কিছু মন্তব্য করেছিল যাকে বোর্ডের কার্যপদ্ধতি বিষয়ে আদালতের সতর্কবার্তা হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। আদালতের মতে, বিসিসিআই এবং সিএবি যে ‘মুনাফা অর্জনকারী সংস্থা’ নয়, তা প্রশ্নাতীত। আদালত আরও বলল, ক্রিকেটের প্রসারে বিসিসিআই দায়বদ্ধ। যে পথে সবচেয়ে বেশি দর্শকের কাছে খেলাটিকে পৌঁছে দেওয়া যায়, সে পথে চলতে বিসিসিআই বাধ্য।
বিসিসিআই-কে সে সময় যে ভাবে দেখা হত, তার সঙ্গে আদালতের এই অবস্থানটি— মুনাফা অর্জন করা নয়, বরং ক্রিকেট নামক খেলাটির প্রসারই বিসিসিআই এবং তার সহযোগী সংস্থাদের মূল দায়িত্ব— খুব খাপ খায় না। কিন্তু, আদালতের পরবর্তী রায়গুলিতে এই অবস্থানই ফিরে ফিরে এসেছে। তার মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ রায়টি সম্ভবত ছিল ২০০৫ সালে জি টেলিফিল্মস বনাম ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের মামলায়। বিসিসিআই নামক প্রতিষ্ঠানটির চরিত্রে কী রকম হওয়া বাঞ্ছনীয় এবং ভারতীয় রাষ্ট্রের সঙ্গে বোর্ডের সম্পর্কটি ঠিক কী, এই মামলার রায় সে বিষয়ে দিকনির্দেশক মুহূর্ত। এই মামলায় আলালতের বিচার্য প্রশ্নগুলির মধ্যে একটি ছিল এই রকম: সংবিধানের ১২ ধারায় রাষ্ট্রের যে সংজ্ঞা রয়েছে, যার মধ্যে ‘অন্যান্য কর্তৃপক্ষ’ নামে একটি বর্গ রয়েছে, বিসিসিআই কি তার অধীনে আসতে পারে? আদালত জানায়, সংবিধানের ১২ ধারার ক্ষেত্রে বিসিসিআইকে ‘অন্যান্য কর্তৃপক্ষ’ হিসেবে বিবেচনা করা চলে না। কিন্তু, বোর্ড এমন কিছু কাজ করে, যেমন জাতীয় দল নির্বাচন, যাকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের সমতুল হিসেবে বিবেচনা করা যায়। অতএব, বোর্ড যদি অন্য নাগরিকের কোনও অধিকার লঙ্ঘন করে, তবে সংশ্লিষ্ট নাগরিকরা সংবিধানের ২২৬ ধারায় আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন। এই ধারায় আদালতের হাতে রিট জারি করার বিপুল ক্ষমতা রয়েছে।
ভারতে খেলা হিসেবে ক্রিকেটের গুরুত্ব তুলনাহীন। ক্রিকেটে টাকার পরিমাণও তুলনাহীন। ফলে, বিসিসিআই বারে বারে আদালতের নজরদারির মুখে পড়েছে। প্রথমে আইপিএল-এর সূত্রে আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হল। তার পর বিসিসিআই বনাম ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বিহার মামলায় সুপ্রিম কোর্ট জানাল, ‘এ দেশে শুধু ক্রিকেটকে ঘিরে বিপুল আবেগই নেই, খেলাটি ভারতের একতা রক্ষার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’, ফলে বোর্ড কোনও দুর্নীতিতে লিপ্ত হলে তা কোনও ভাবেই বরদাস্ত করা হবে না। তার পর, ২০১৫ সালের ২২ জানুয়ারি আদালত প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি আর এম লোঢার নেতৃত্বে একটি তিন সদস্যের কমিটি তৈরি করে দিল— ভারতে ক্রিকেট প্রশাসনের আমূল সংস্কারের উদ্দেশ্যে।
২০১৬ সালের জুলাই মাসে সুপ্রিম কোর্ট লোঢা কমিটির বেশির ভাগ সুপারিশই মেনে নিল। ফের জানাল, বিসিসিআই যে দায়িত্ব পালন করছে, তা চরিত্রে সরকারি কাজের সমগোত্রীয়, ফলে সরকারি কাজের ক্ষেত্রে যে আইন মেনে চলতে হয়, বিসিসিআই-এর ক্ষেত্রেও সেই কড়াকড়িই প্রযোজ্য। সংস্থাকে যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত করার, নিরপেক্ষতার, দায়বদ্ধতার ও স্বচ্ছতার নীতিগুলি মানতেই হবে।
আদালতের নির্দেশে বিসিসিআই-এর অভ্যন্তরীণ কাজকর্মে অনেকখানি হস্তক্ষেপ করার এবং নিয়ন্ত্রণের পরিসর তৈরি হয়েছে। আদালতের মতে, বোর্ডের কাজকর্ম সরকারি কাজের সমগোত্রীয়। আরও দুটি কথা মাথায় রাখা প্রয়োজন। এক, সুপ্রিম কোর্ট নিজের জন্য এমন একটি জায়গা তৈরি করে নিয়েছে যে তার পক্ষে জনজীবনের কার্যত যে কোনও পরিসরে হস্তক্ষেপ করা সম্ভব। দুই, আদালতের এই হস্তক্ষেপ যে বৈধতা পেয়েছে, তার পিছনে সেই হস্তক্ষেপগুলির প্রতি ভারতের মধ্যবিত্ত সমাজের বিপুল সমর্থনের কথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। ভারতের জনসমাজের চোখে ক্রিকেটের এমনই গুরুত্ব যে বিসিসিআই-এর পরিসরে আদালতের এই হস্তক্ষেপও প্রায় সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে।
ব্যতিক্রম শুধু বিসিসিআই।
ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর-এ কর্মরত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy