Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

পথসন্ধিতে রাজ্য রাজনীতি

সা ম্প্রদায়িকতা এবং উগ্র হিন্দুত্বকে বাঙালি সমাজ প্রতিহত করবে নিজের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য দিয়ে, এ রকম ভাবতে ভাল লাগে। কিন্তু এ ভাবনায় ফাঁকি আছে। ’৪৬-এর দাঙ্গা আমরা ভুলে গেছি।

আহ্বান: ‘আগ্রাসী শক্তি প্রদর্শনের রাজনীতিকে প্রতিরোধ করা যায় দৃঢ় প্রশাসন এবং জনসমাবেশের সাহায্যে।’ ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

আহ্বান: ‘আগ্রাসী শক্তি প্রদর্শনের রাজনীতিকে প্রতিরোধ করা যায় দৃঢ় প্রশাসন এবং জনসমাবেশের সাহায্যে।’ ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

রণবীর সমাদ্দার
শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৭ ০০:১৯
Share: Save:

সা ম্প্রদায়িকতা এবং উগ্র হিন্দুত্বকে বাঙালি সমাজ প্রতিহত করবে নিজের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য দিয়ে, এ রকম ভাবতে ভাল লাগে। কিন্তু এ ভাবনায় ফাঁকি আছে। ’৪৬-এর দাঙ্গা আমরা ভুলে গেছি। সত্তর বছর পরে তা ভুলে যাওয়ারই কথা। কিন্তু সমাজের যে ভেদরেখাগুলো ওই মর্মান্তিক দাঙ্গার মূলে ছিল, আজও আছে। কিছু ভেদরেখা হয়তো স্তিমিত হয়েছে। কিন্তু কিছু ভেদরেখা আজ আরও স্পষ্ট।

আজও হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক অবিশ্বাস আছে। বরং প্রবল সর্বভারতীয় প্রচারযন্ত্রের কল্যাণে ও রাষ্ট্রীয় মদতে হিন্দুদের মাঝে এক ব্যাপক ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান-তোষণ চলছে, এবং জনসাধারণের আর্থিক দুর্দশার পিছনে এই মুসলমান-তোষণ দায়ী। উচ্চ এবং মধ্যবর্ণ হিন্দুদের মধ্যে এ ধারণাও আছে যে, বিদ্যাচর্চার মান অধোগামী, তার কারণ দলিতদের জন্য আসন সংরক্ষণ। দলিতদের মধ্যে বর্ণহিন্দু সমাজে ফিরে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। ফলে দলিত-মুসলমান সংঘর্ষ, হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষ ছোটখাটো ভাবে ঘটছে। এবং সম্পদ নিয়ে বিবাদ প্রায়ই ধর্মবিবাদে পরিণত হচ্ছে।

’৪৬-এর দাঙ্গা বাংলার একমাত্র কলঙ্ক নয়। কলকাতার এবং সামগ্রিক ভাবে বাঙালি নাগরিক সমাজের গণহত্যা প্রত্যক্ষ এবং সহ্য করার ইতিহাস ঈর্ষণীয়। স্বাধীনতার আগে ঢাকা, কলকাতা, খুলনা— এ সব শহরে দাঙ্গা তো ঘটতই, গ্রামেও দাঙ্গা হত। নোয়াখালিও ভোলার নয়। সবচেয়ে বড় কথা, কলকাতার নাগরিক সমাজ ১৯৭০-৭১-৭২-এর ব্যাপক গণহত্যা প্রত্যক্ষ করেছিল। সহ্যও করেছিল নীরবে। তার পর স্বৈরতন্ত্রের জয়গানে যোগও দিয়েছিল।

কাজেই সাম্প্রদায়িকতা, গণহত্যা, বর্ণসমাজসুলভ প্রতিক্রিয়াশীলতা বাঙালি সমাজের রক্তে আছে। স্তিমিত হলেও, উপযুক্ত আশ্রয় এবং পৃষ্ঠপোষকতায় আবার এই দুর্দিন ফিরবে না, এমন নিশ্চিত হওয়া যায় না। এই অবস্থায় যাঁরা ভাবছেন যে, সংকীর্ণ রাজনীতি, সরকার-বিরোধিতা, সংসদীয় কোন্দল এবং ভোট জোগাড়ের আপ্রাণ প্রয়াসের রাজনীতি দিয়ে দুর্দিনের তরী ভাসানো যাবে, তাঁরা যতই বামপন্থী হোন, নিজেদেরই প্রতারিত করছেন।

কিন্তু অন্ধ হয়ে থাকলে তো প্রলয় বন্ধ হয়ে যায় না। তাই বামপন্থী সংসদীয় রাজনীতির যে অবশ্যম্ভাবী পরিণাম, তা নিয়ে হা-হুতাশ করে কত কাল কাটানো যাবে? যে জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতি দিয়ে আজ এই সর্বগ্রাসী আক্রমণাত্মক শক্তিকে ঠেকিয়ে রাখা গিয়েছে, তার ফাঁকফোকরগুলো তো ভুললে চলবে না। মনে রাখতে হবে, কালনাগ ঢুকেছিল বাসরঘরের ছিদ্র দিয়েই।

ব্যাপারটা জটিল। কিন্তু খোলসা করে বলা দরকার। যে জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতিতে পশ্চিমবঙ্গের বদ্ধদশা সাময়িক ভাবে কাটল, সেই রাজনীতি তো চিরস্থায়ী হবে না। জনকল্যাণমূলক কাজ হয়েছে, প্রশাসনকে অধিক দায়িত্ববান হতে হয়েছে, মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে প্রশাসনের জনসংযোগ অনেক বেড়েছে, ক্ষমতার অংশীদাররূপে সমাজের নতুন স্তর উঠে এসেছে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে নতুন নতুন জেলা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে। নব্য উদারবাদী বিশ্বায়নের কালেও সব মিলিয়ে এক জনমুখী রাজনীতির প্রচলন হয়েছে, যার চরিত্র জনপ্রিয়তাবাদী।

এই জনপ্রিয়তাবাদী শাসনকে বার বার অসংখ্য মানুষ সমর্থন জানিয়েছে। কিন্তু শাসন চলেছে এক অপেক্ষাকৃত শক্ত প্রশাসনের ভিত্তিতে, পুরনো বামপন্থী জমানার মতো দলীয় সংগঠনের ভিত্তিতে নয়। ফলে, এর ভাল দিক যেমন আছে, তেমনই মন্দ দিক আছে। উপদলীয় কলহ, নীচের স্তরে খাজনাসুলভ আয়ের বখরা নিয়ে মারামারি, এবং ক্ষমতার মত্ততায় নানা জায়গায় জনসাধারণের প্রয়োজন, ইচ্ছে ইত্যাদিকে অস্বীকার করা— এ সব নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সব আগেও ছিল। কিন্তু দলীয় নিয়ন্ত্রণ এগুলোকে সামলে রাখত। আজ বর্তমান প্রশাসনের দিক থেকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিচক্ষণতা, দৃঢ়তা এবং ক্ষিপ্রতা না দেখালে এই সমস্যা হাতের বাইরে চলে যাবে। মনে রাখা দরকার, যে উন্নত পরিবহণ, যোগাযোগ এবং যাতায়াত ব্যবস্থা আজ প্রশাসনকে সাহায্য করছে রাজ্য সামলাতে, সেই পরিবহণ, যোগাযোগ এবং যাতায়াত ব্যবস্থার মাধ্যমেই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি দ্রুত রাজ্যের নানা জায়গায় পৌঁছবে। এই অবস্থায় রাজ্য প্রশাসনকে অনেক মূল্য দিতে হবে, যদি জনসাধারণের নানা স্থানের অসন্তোষকে উপেক্ষা করা হয়। আলোচনার পথ থেকে সরে যদি দলীয় ও পুলিশি শক্তিতে আস্থা রাখা হয়, এই সব বিক্ষিপ্ত অসন্তোষ এবং প্রতিবাদ এক ব্যাপক ধূমায়িত অগ্নিকাণ্ডে পরিণত হতে সময় লাগবে না। এবং তা যদি হয়, তা হয়তো হবে সহসা। আগাম না জানিয়ে।

প্রশাসনের যদি ক্ষমতা সীমিত থাকে, সে প্রশাসনের অন্তর্নিহিত ক্ষমতা যদি উচ্চ মানের না হয়, সেই প্রশাসন অসন্তোষকে সামলাতে পারে না। কথাবার্তার রাস্তা থেকে তখন সরে আসে সেই প্রশাসন। সংঘর্ষের পথ ধরে। তাতে প্রশাসনের শক্তি আরও কমে যায়। এখন পশ্চিমবঙ্গে সে পরিস্থিতি আসেনি। কেননা, এই শাসন এখন জনপ্রিয়তাবাদী। জনসাধারণের কিছু কল্যাণ, কিছু উন্নতি এই প্রশাসনের এখনও লক্ষ্য।

কিন্তু যে আগ্রাসী সাধারণ শক্তি আজ দেশ জুড়ে উদ্যত, তাকে মোকাবিলা করার মতো রসদ এক জনপ্রিয়তাবাদী সরকারের কতটা থাকতে পারে? জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতি সম্বল করে কত দূর এই আগ্রাসী শক্তিকে প্রতিহত করা যাবে? জনসাধারণের নানা অসন্তোষ এই আগ্রাসী রাজনীতির শিকার হবে না, কে বলতে পারে? বিশেষত জনসাধারণের অসন্তোষকে এই আগ্রাসী, মারমুখী পথে নিয়ে যেতে নাগরিক সমাজের এক বড় অংশের সক্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমনিতেই এই শিক্ষিত শ্রেণি সুবিধে পেয়ে আরও সুবিধে চায়। ধন পেলে আরও ধনলোভী হয়ে ওঠে। ‘পরিবর্তন’ মানে স্বর্গ আসবে, এরা ভেবেছিল। আজ স্বর্গ না পাওয়ার হতাশা এবং ক্রোধ এদের মধ্যে প্রবল। এবং এরাই সবচেয়ে বেশি দোষারোপ করে নীচের মহলের বাউন্ডুলেপনাকে। এই অবস্থায় আগ্রাসী শক্তির মাদকতায় এই মধ্যশ্রেণি উন্মত্ত হয়ে উঠলে বিস্ময়ের কিছু নেই। জনপ্রিয়তাবাদী শক্তির উত্তরও হয়তো অভিনব। বাংলার নানা শহরে শাসক দলের লোকজন রামনবমী, হনুমান পুজো ইত্যাদিতে মেতেছেন। এ যদি ধর্মাচরণ হয়, ভাল কথা। এতে যদি উগ্র হিন্দুত্বের পালের হাওয়া কেড়ে নেওয়া যায়, সে-ও ভাল। কংগ্রেসের কর্মীরাও দীর্ঘ দিন এই নীতি নিয়ে চলেছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন হল: এই পন্থার পরিণামে উগ্র ধর্মীয়তারই যাথার্থ্য স্বীকার করে নেওয়া হবে না কি? বাংলার যে শাশ্বত সংস্কৃতির কথা বলা হচ্ছে, এই ভাবে কি তাকে রক্ষা করা বা দৃঢ় করা যাবে?

দ্বিতীয় প্রশ্ন আরও গুরুত্বপূর্ণ। আগ্রাসী শক্তি প্রদর্শনের রাজনীতিকে প্রতিরোধ করা যায় দৃঢ় প্রশাসন এবং জনসমাবেশের সাহায্যে। দুটোই দরকার। উসকানিতে পা দেওয়া ঠিক নয়। কিন্তু শৈথিল্য অনেক সময় আগ্রাসী শক্তি প্রদর্শনকে আরও উৎসাহিত করে বা করবে। অন্য দিকে যে নতুন পথে সাম্প্রদায়িকতা এবং উগ্র ধর্মীয়তার বিরোধিতা করা দরকার, তাতে জনসমাবেশ ও জনসমর্থন এবং শক্ত প্রশাসন— দুই-ই আবশ্যক। এটা লক্ষণীয় যে, এই বার রামনবমী এবং হনুমান পুজো নিয়ে যে মাতামাতি দেখা গেল, তা বাঙালির পয়লা বৈশাখে দেখা গেল না। অথচ পয়লা বৈশাখ তো হিন্দুদের দিন নয়, এটা হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবার দিন। তেমনই বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসে আরও অনেক রসদ আছে, যাকে উগ্র ধর্মীয়তার বিরুদ্ধে শামিল করতে হবে। এর জন্য নিরন্তর জনসমাবেশ প্রয়োজন।

বামপন্থী রাজনীতি বেশ কিছু দিন হল রাইটার্সে ফেরার প্রবল আকাঙ্ক্ষায় এ সব মূল কথা থেকে বিস্মৃত হয়েছে। এঁদের তৃণমূল বিরোধিতা আজ দক্ষিণপন্থী শক্তির প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থনে পর্যবসিত। অন্য দিকে, জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতির সম্ভাবনা এখনও নিঃশেষ হয়ে যায়নি। কিন্তু তার সীমাবদ্ধতা প্রকট। তার কিছুটা কাটাতে পারলে তবে এই আগ্রাসী শক্তিকে প্রতিহত করা যাবে।
এই সব দিক থেকে বলা যায়, বাংলার রাজনীতি আজ এক উভয়সংকটের মাঝে দাঁড়িয়ে। এবং প্রগতিশীল শক্তির অগ্রগতি এই সংকটকে উপলব্ধি করার ওপর নির্ভরশীল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bengal Politics Crisis
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE