Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

ভাষাহারা বাঙালি

ইদানীং কালে বাঙালির মনের ভাবটি হইল, বাঙালির জয়জয়কার হউক, কিন্তু বাংলা ভাষা যত দ্রুত সম্ভব উঠিয়া যাক। বাঙালিকে বাংলা বাদ দিয়াই বড় হইতে হইবে। ইংরেজিনবিশ তো হইতে হইবেই, বিশ্বায়নের যুগ। (তাহা ছাড়া সেই কোন কাল হইতেই বাঙালির ইংরেজি শিক্ষার মহিমা বন্দিত।)

শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

ইদানীং কালে বাঙালির মনের ভাবটি হইল, বাঙালির জয়জয়কার হউক, কিন্তু বাংলা ভাষা যত দ্রুত সম্ভব উঠিয়া যাক। বাঙালিকে বাংলা বাদ দিয়াই বড় হইতে হইবে। ইংরেজিনবিশ তো হইতে হইবেই, বিশ্বায়নের যুগ। (তাহা ছাড়া সেই কোন কাল হইতেই বাঙালির ইংরেজি শিক্ষার মহিমা বন্দিত।) তাহার সঙ্গে হিন্দিনবিশও হওয়া দরকার, রাষ্ট্রভাষা না শিখিলে চলে কি! মোহনদাস গাঁধীও জীবনের শেষ কয়েকটি বছরে নিয়ম করিয়া বাংলা ভাষায় বলা ও লেখা অভ্যাস করিতেন, অথচ হিন্দি-ইংরেজিময় স্বাধীন দেশের নাগরিক হইয়া উঠিবার সাধনায় বাঙালিকে আবশ্যিক ভাবে ভাঙা বাংলায় কথা বলিতে হয়, বাংলা উচ্চারণ বিকৃত করিতে হয়, হিন্দি বা ইংরেজির আদলে বাংলা শব্দবন্ধ সাজাইয়া লইতে হয়, সদর্পে ঘোষণা করিতে হয়, সন্তানরা বাংলাটা ঠিক শিখে নাই, বলিতে বড় কষ্ট। বিদ্যালয়গুলির দিকে তাকালেই চিত্র পরিষ্কার। আপামর অভিভাবককুলের বিবেচনায়, ইংরেজি প্রথম ভাষা, দ্বিতীয় ভাষা হিন্দি। এই অভিভাবককুলের মধ্যে বাঙালিরা বিরাট স্থানের অধিকারী, বহু ক্ষেত্রে তাঁহাদের অবাঙালি প্রতিযোগী অভিভাবকদের ছাপাইয়া যাইতেও সমর্থ। এই প্রবণতা নূতন নয়, কিন্তু সময়ের সহিত প্রবণতাটির যে প্রবল প্রসার ও প্রচার ঘটিতেছে, তাহা নজরযোগ্য। পশ্চিমবঙ্গ হইতে বাংলা দ্রুত পশ্চাদপসরণশীল। কিছু দিন পরই বাংলা ভাষার একমাত্র আশ্রয় হইবে বাংলাদেশ। জাতিসত্তা লইয়া তো আজকাল দুর্ভাবনা ঘরে ঘরে: জাতীয়তাবাদের পালে ঝোড়ো বাতাস দিকে দিকে। ইত্যবসরে ভাষার কথাও খানিক ভাবিলে হয়। পূর্ববঙ্গের ভাষা যে বাংলা, রক্তের মূল্যে তাহা প্রতিষ্ঠিত। পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালির ভাষা বাংলা কি না, এ পারেও সেই মূল প্রশ্নটি আবার খতাইয়া দেখা যায়। বিশেষত বাংলা নববর্ষের ছুটির অবকাশে।

বাঙালির বঙ্গ ভারতের অন্যান্য আঞ্চলিক অধিবাসীদের উদাহরণে উদ্বুদ্ধ হইতে পারে। সম্প্রতি কেরল বিধানসভায় অর্ডিন্যান্স পাশ হইয়াছে: রাজ্যের সমস্ত বিদ্যালয়ে (সিবিএসই, আইসিএসই বিদ্যালয়গুলিতেও) দশম শ্রেণি পর্যন্ত মালয়ালি ভাষা বাধ্যতামূলক, মালয়ালি ভাষার বিরুদ্ধে প্রচার নিষিদ্ধ, নিয়ম লঙ্ঘন করিলে বিদ্যালয়গুলির উপর বড় অঙ্কের ফাইন প্রযোজ্য। কেবল ভিন্ন রাজ্যের নাগরিক কেরলের অধিবাসীদের জন্য ব্যতিক্রম গ্রাহ্য। এত কড়া আইন জরুরি ছিল কি না, তাহা আলোচনার বিষয়। কিন্তু আইন প্রণয়নের পরিবেশটি আদৌ কেন তৈরি হইল, সে আলোচনাও কম প্রয়োজনীয় নয়। এবং, যে দেশ নিজেকে যুক্তরাষ্ট্র বলিয়া দাবি করে, যে দেশের প্রাদেশিক দলগুলি কেন্দ্রের বিপরীতে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় সতত মুখর, সেখানে প্রাদেশিক ভাষাগুলির হাঁড়ির হাল হইলে কী ভাবে প্রাদেশিক সত্তা বাঁচিয়া থাকিবে, তাহা সবচেয়ে বড় আলোচ্য।

অর্ডিন্যান্স কিংবা আইন করিয়া ভাষা রক্ষার চেষ্টার মধ্যে সরকারি শক্তির অতি-প্রদর্শন আছে, ইহা একটি নেতি-নীতি। কিন্তু ভাষার প্রাণ ও সম্মান কি নেতি-র উপর ভর করিয়া বাঁচানো যায়? যে ভাষাকে জোর করিয়া বাঁচাইতে হয়, তাহার মৃত্যু অবধারিত, দূর কিংবা অদূর ভবিষ্যতে। বরং ভাবা দরকার, এই ভাষাগুলিকে বিস্মৃতি ও অবজ্ঞার অতল হইতে তুলিবার লক্ষ্যে কী কী করণীয়। ঠিকই, রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছিলেন, যে ভাষার সাহিত্য দুর্বল সে ভাষার ভবিষ্যৎও দুর্বল। তবে কিনা, আজকের যুগে সুসাহিত্যকে ভাষা বাঁচাইবার পর্যাপ্ত শর্ত বলা মুশকিল। বাংলা সাহিত্যের মান এখনও ফেলনা নহে, তবুও বিশ্বায়ন, বলিউড এবং গোবলয়ের একত্র প্রতাপের বিরুদ্ধে বেচারা সাহিত্য বস্তুটি কত দূরই বা লড়িতে পারিবে। বাংলায় লেখা, বাংলায় পড়া, বাংলায় শোনা— এই তিন লক্ষ্য পূরণের ত্বরিত পথ প্রণয়ন না করিলে ভারতীয় বাঙালির যবনিকাপাত কেবল সময়ের অপেক্ষা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE