Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

দিনে দিনে ভাষার কী হাল দাঁড়িয়েছে

ভাষাবিদ নই। কিন্তু যুগের সুবাদে বহুজনের সঙ্গ লাভ করে নিজের কত ভুল শুধরেছি। এখন খবরের কাগজ, গল্প-উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধের বই, এবং কৌতূহল মেটাতে স্কুলকলেজের বই পড়তে পড়তে হোঁচট খাই।

চিরঞ্জীব
শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

ভাষাবিদ নই। কিন্তু যুগের সুবাদে বহুজনের সঙ্গ লাভ করে নিজের কত ভুল শুধরেছি। এখন খবরের কাগজ, গল্প-উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধের বই, এবং কৌতূহল মেটাতে স্কুলকলেজের বই পড়তে পড়তে হোঁচট খাই। রেডিয়োর সংবাদ, ঘোষণা, টিভি চ্যানেলে বাংলা শব্দের বানান ও সঞ্চালকদের কথা শুনে আঁতকে উঠি। অতীতে ভাবতাম, দিন-কে-দিন ভুল কমে যাবে, তা হল কই!

অকপটে জানাই, বাংলা শব্দ, ভাষা, বাক্য নিয়ে আমার জ্ঞান অতি সামান্যই। অতীতে এ সব নিয়ে জ্যোতিভূষণ চাকী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, বিমল কর, সুধীর চক্রবর্তী, পবিত্র সরকার, সুবাস মৈত্রদের সঙ্গে দেখা করে বা ফোনে আমার ভুল শুধরে নিতাম। বিমল কর, জ্যোতিভূষণ চাকী, সুবাস মৈত্র প্রয়াত। নীরেনদাকে বিরক্ত করতে দ্বিধা হয়। হয়তো বলবেন, এই বয়সে তোর এত মাথাব্যথা কেন? পবিত্রবাবুর সঙ্গেও যোগাযোগ নেই।

কিছু দিন আগের ঘটনা। রানিকুঠি মোড়ে দাঁড়িয়ে। একটি ইংরেজি স্কুলের ছাত্রীরা বিরিয়ানির দোকানে লাইন দিয়েছে। এক জন ছাত্রী বিক্রেতাকে বলছে, মাটন বিরিয়ানি লিখবেন না। আপনারা তো পাঁঠা বা খাসির মাংস ব্যবহার করেন। মাটন মানে তো ভেড়া বা মেষের মাংস।

বাড়ি ফিরে ডিকশনারি খুললাম। এত দিন ভুল জেনে এসেছি! ডিকশনারিতে দেখি মেয়েটি ঠিক কথাই বলেছে। কেউ কেউ বলেন, বহুব্যবহৃত হলে ভুলটা আর ভুল থাকে না। তা হলে আমি আপনার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করি না— এখানে ‘ব্যবহার’ কথাটা হওয়া উচিত ‘আচরণ’। বিহেভিয়ার তো তা-ই হয়। আমি ডিভিডি-টা ঠিক ভাবে ব্যবহার করতে পারি না। এখানে ‘ইউজ’। কিন্তু ‘ব্যবহার’ কথাটা যত্রতত্র ব্যবহার করি।

এক বার একটি নামী দৈনিকের বড় শিরোনাম ‘বিধানসভার ১০০ জন সদস্য সোচ্চার’। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা হতেই কাগজটা দেখিয়ে লুটোপুটি। বিধানসভা কক্ষ তো দুর্গন্ধে ভরে গিয়েছে! বুঝতে পারছি না। থতমত। বললেন, ওটা হবে ‘সরব’। সোচ্চার মানে নিজে উচ্চারিত। খারাপ কথায়, বাতকর্ম। গণ্ডগোল বা হইচই করাটা সোচ্চার নয়। উনিই এক দিন ভোটের প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচের হোর্ডিং দেখিয়ে বলেন, মরণবাঁচন লড়াই কেন? মরার জন্য কেউ লড়ে? ভাবি, ইংরেজি ‘ডু অর ডাই’-এর উৎপত্তি কেন।

মতি নন্দী চালু করেন আইএফএ সচিব, সিএবি সচিব। আগে লেখা হত সম্পাদক। উনি বলতেন, রাষ্ট্রপুঞ্জের সেক্রেটারি জেনারেল মহাসচিব, চিফ সেক্রেটারি মুখ্যসচিব। খেলার সংস্থাতেও সেক্রেটারি সচিব। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়— তা হলে কংগ্রেসের সেক্রেটারি, কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি কী হবে? বলেন, অবশ্যই সচিব। কেবলমাত্র এডিটরই সম্পাদক। বলতেন, টেস্ট ডেবিউ মানে টেস্টে অভিষেক। কখনও দ্বিতীয় বার অভিষেক হয় না। মুখ্যমন্ত্রী দ্বিতীয় বার শপথ নেন, দ্বিতীয় বার নির্বাচনে জেতেন বলেই। ইংরেজিতে ‘হি সেজ দ্যাট’। উনি বাংলা তর্জমা করতেন, তিনি বলেন। ‘বলেন যে’ পছন্দ করতেন না। অপছন্দ ছিল ‘হঠাৎ করে’। হঠাৎই তো যথেষ্ট।

এক অনুজপ্রতিম সাংবাদিক আমার আকাশবাণী-প্রীতি শুনে বলে, ওরা প্রায়ই ‘ভোর রাতে’ শব্দটি বলে। কাগজেও এটা হেডিং হয়। প্রায়ই লেখা বা বলা হয় ‘এ জাতীয়’। হওয়া উচিত ‘এ ধরনের’ বা এ রকম। হিন্দু বা মুসলিম জাতি। স্ত্রী জাতি অবশ্য ভিন্ন কথা। ন্যাশনাল-ই জাতিগত বা জাতীয়। যেমন, জাতীয় ক্রিকেট, দল, জাতীয় আয়, জাতীয় পশু, জাতীয় সংগীত, জাতির জনক।

একটি ক্যুইজ কম্পিটিশনে এক ছাত্র উলটে ক্যুইজ মাস্টারকে জিজ্ঞেস করে, স্যর, শূন্য রান-টা কী? ডাক মানে 0। শূন্য রান কেন? বুঝি, সংখ্যা নিয়ে সে চর্চা করে। ওর আরও প্রশ্ন ছিল, বোলিং করা, ব্যাটিং করা— পাশাপাশি দুটো ক্রিয়াপদ কেন? SH থাকলে উচ্চারণ হয় ‘শ’। তা হলে, ASHES তো অ্যাশেজ হওয়া উচিত। কিন্তু লেখা হচ্ছে অ্যাসেজ। টেনিসে সেট ও গেম নিয়ে আকছারই ভুল হচ্ছে। ষাট-সত্তরের দশকে আকছার ‘স্বর্গারোহণ’, ‘ইহলোক ত্যাগ’, ‘পরলোক গমন’ লেখা হত; এখন প্রায় বন্ধ হয়েছে। তবে খামের উপর বা চিঠিতে ‘ওঁ গঙ্গা’ কেন? বুঝি না। সর্বজনীন এখনও ‘সার্বজনীন’ দুর্গোৎসব হয়ে আছে।

অতীতে দেখেছি, সরকারি বাসের গেটে লেখা ‘বাস না থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন’। Till Stop-এর এ কেমন তর্জমা! তা হলে তো বাস থামবে না। ঠিক হত ‘বাস থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন’। ‘মুখ্যমন্ত্রী না আসা পর্যন্ত সভা হবে না’, এটা তো ভুল। হওয়া উচিত ‘মুখ্যমন্ত্রী এলেই সভা হবে’। আকছারই লেখা হয় ‘ফলশ্রুতি’। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে ‘কর্মফল শ্রবণ’। কিংবা মুখ্যমন্ত্রী ‘পায়ে হেঁটে’ রাজভবন গেলেন। উনি কি হাতেও হাঁটেন? অথবা দুর্ঘটনার খবর পেয়ে প্রধানমন্ত্রী ছুটে যান? হ্যাঁ, নরেন্দ্র মোদীর বডি খুব ফিট, তা বলে উনি দৌড়ে যান? আর মুঠো তো হাতেই। হাতের মুঠো কেন লেখা হবে? কোয়েশ্চেন-এর মানে প্রশ্ন। কাশ্মীর সমস্যা, তিস্তা সমস্যা হোক। ‘তিস্তা প্রশ্নে’, ‘কাশ্মীর প্রশ্নে’ কেন হবে‌? মাঝে মাঝে মনে হয়, দুর্ঘটনাস্থল না লিখে দুর্ঘটনাস্থান লিখলে কেমন হয়? গঙ্গায় নৌকোডুবি হলে কি দুর্ঘটনাস্থল লেখা হবে?

— অলস আমি। অনেক উদ্ভট চিন্তা, তাই লিখলাম। ভুলও হতে পারে। কিন্তু ভাষাবিদরা ঠিক পথ দেখান। বাংলা ভাষাকে বাঁচান। ও পার বাংলা পারে, এ পার বাংলা পারবে না কেন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE