Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

তবে তো শশীবাবুতেও হ্রস্ব ই-কার দেওয়া দরকার

বানান নিয়ে ভাবনা কিন্তু দেশপ্রেমের, ভাষাপ্রেমের কাজ অনেক দিন বানান নিয়ে তর্কবিতর্ক হয় না, তাই এই এলাকায় পরিবেশটা একটু নিরিমিষ-নিরিমিষ লাগে। সুযোগ পেয়ে ওই দিক থেকে পাঠকের উপর নতুন আক্রমণের, এবং প্রতি-আক্রমণের পরিসর সৃষ্টির, উদ্যোগ নেওয়া গেল।

বর্ণমালা: ভাষা দিবস, বানানের পর বানান সাজিয়ে তৈরি ‘ভাষা’র উদ্‌যাপন। ভাষা শহিদ মিনার, ঢাকা। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫। ছবি: বাপি রায়চৌধুরী

বর্ণমালা: ভাষা দিবস, বানানের পর বানান সাজিয়ে তৈরি ‘ভাষা’র উদ্‌যাপন। ভাষা শহিদ মিনার, ঢাকা। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫। ছবি: বাপি রায়চৌধুরী

পবিত্র সরকার
শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৭ ০০:৪২
Share: Save:

অনেক দিন বানান নিয়ে তর্কবিতর্ক হয় না, তাই এই এলাকায় পরিবেশটা একটু নিরিমিষ-নিরিমিষ লাগে। সুযোগ পেয়ে ওই দিক থেকে পাঠকের উপর নতুন আক্রমণের, এবং প্রতি-আক্রমণের পরিসর সৃষ্টির, উদ্যোগ নেওয়া গেল।

আমাদের বানান-নীতি পেন্ডুলামের মতো দু’প্রান্তের টানাটানিতে নির্ধারিত হয়েছে। এ দুটি ভাষাবিজ্ঞানসম্মত— এক দিকে উচ্চারণ-অনুযায়ী বানানের ইচ্ছা, অন্য দিকে ব্যুৎপত্তি বা মূলের বানানের স্বীকৃতি। যে সব সংস্কৃত শব্দকে মূলের বানানে গ্রহণ করা হয়েছে— সব ক্ষেত্রে উচ্চারণে হয়নি— সেই সব তথাকথিত ‘তৎসম’ শব্দে মূলের বানান যথাসম্ভব অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। তিনটি প্রধান ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম ঘটেছে, তার মধ্যে দুটিই সংস্কৃতে বিকল্প ছিল। এক, রেফের নীচে একই ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব বর্জন, আর দুই, সংস্কৃতের দীর্ঘ ঈ-কার, দীর্ঘ ঊ-কার, ঋ-কার, স-এর বদলে হ্রস্ব ই-কার, উ-কার, র-ফলা হ্রস্ব ই-কার, তালব্য শ-কে গ্রহণ। প্রথমটির উদাহরণ বাহুল্যমাত্র; দ্বিতীয়টির উদাহরণ অবনি, পেশি, শ্রেণি, উর্ণা, উষা, ক্রিমি, শায়ক ইত্যাদি। সবাই এগুলি জানেন বা লেখেন, তা নয়। আর তিন, সংস্কৃত -ইন্‌ প্রত্যয়ান্ত শব্দের শেষে প্রথমার একবচনে যে দীর্ঘ ঈ-কার হত, তার সঙ্গে, প্রত্যয়যোগে নয়, শব্দের সমাস হলে তা রক্ষিত হয়েছে। তাই এখন ‘শশীভূষণ’ (সাধারণ শব্দে, নামে নয়), ‘মন্ত্রীগণ’ লেখার বিধান। এখানে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন, ‘আগামিকাল’ কেন হবে? তা ‘আজকের পরের দিন’ বোঝালে এই ‘কাল’ তো তৎসম শব্দ নয়, তা ‘কল্য’-র তদ্ভব রূপ। তৎসম-তদ্ভবর সমাসে -ইন্‌-এর দীর্ঘ ঈ-কার বর্জিত হবে? তা হলে ‘শশীবাবু’-তেও হ্রস্ব ই-কার দেওয়া দরকার ছিল। আর ‘আসন্ন সময়’ বোঝাতে ‘আগামী কাল’ লেখাই বাঞ্ছনীয়।

অর্ধ-তৎসম আর তদ্ভব শব্দে এই টানাপড়েন বেশি দেখা যায়। তাই উচ্চারণের দিকে ঝুঁকে দীর্ঘ স্বরচিহ্ন আর ঋ-কার বাদ গেছে, কিন্তু ষ বাদ দেওয়া যায়নি (চাষ, ঘোষ, মোষ), যদিও বাংলায় মূর্ধন্য ষ-এর একক উচ্চারণ নেই।

বানান-নীতি নির্ধারণে একটা সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক নীতিও হয়তো বিবেচনায় আনা উচিত ছিল। তা হল, মূলত প্রথম শিক্ষার্থীদের সুবিধার জন্য— এক শব্দের এক বানান। মনে রাখতে হবে, সংবাদপত্র বা লিখিত সাহিত্য ও অ-সাহিত্যের পাঠক শুধু প্রাপ্তবয়স্করা নন, অসংখ্য ছাত্রছাত্রী। এমনকি (‘এমনকী’ কেন নয় পরে বলছি) নবসাক্ষর শিশু আর বয়স্করা অন্তত খবরের শিরোনামগুলি দেখে। তাদের এই বলে কেউ যদি সাবধান করেও যে, ‘বাপু হে, তোমরা তোমাদের পাঠ্যবইয়ে এক শব্দের এক বানান মোটামুটি দেখছ, শিখছ— সারা জীবন এই বানানই লিখবে বলে আমরা আশা করি। কিন্তু পাঠ্যবইয়ের বাইরে, তোমরা নানা রকম বানানের জন্যে তৈরি থাকো। দেখবে অনেক বানান, লিখবে যেটি শিখেছ সেটি।’ তবু কি এই ব্যবস্থা চলা উচিত? আমরা বাংলা বানান আদর্শায়নের (আচ্ছা, আচ্ছা— স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন) দিকে এগোব না? (‘এগব’ কেন নয়, তা-ও পরে দেখুন।)

বাংলা সংবাদপত্রগুলি যে নানা রকম বানান লেখে, তার মূলেও নিশ্চয়ই তাদের কোনও নির্ধারিত নীতি আছে, যা যোগ্য মানুষেরাই তৈরি করেছেন। এই নীতির মধ্যে ব্যাপকভাবে বাংলা বানান সংস্কার আর সমতাবিধানের যে মূল ধারা— অর্থাৎ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, বিশ্বভারতী ও পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি— তা-ই অধিকাংশত অনুসরণ করা হয়েছে, তা-ও লক্ষ করি। সেটা একটা স্বস্তিদায়ক ঘটনা। আর আনন্দবাজার পত্রিকাকে অন্যান্য কিছু দৈনিক ও সাময়িক পত্র অনুসরণ করে, ফলে মূলধারার বানানের কাছাকাছিই থাকে।

এই মূলধারার বানান থেকে বাংলা সংবাদপত্র সরে যাওয়ার দৃষ্টান্তও আছে। বাংলা ক্রিয়াপদের বানানে কোনও কোনও পত্রিকা অতীত কালের ‘-ল’ আর ভবিষ্যৎ কালের ‘-ব’-তে ও-কার দেয়। সম্ভবত বানানে উচ্চারণকে প্রতিফলিত করার জন্য। তার দেখাদেখি আরও অনেকে তা-ই করেন। তা ছাড়া সুনীতিকুমার-প্রশান্ত মহলানবিশের বর্জিত ও জটিল বানান-সুপারিশ মেনে অনেকে, বিশেষ করে বুদ্ধদেব বসুর অনুগামীরা, ঊর্ধ্বকমা, হসন্ত, ও-কার— সবই ব্যবহার করেন। ঢাকার বাংলা একাডেমিও হতো, হলো (২০১২) বানান সুপারিশ করেছে। কিন্তু এতে কি উচ্চারণ পুরোপুরি প্রতিফলিত হয়? করলো, বলবো, হলো, হতো ইত্যাদির উচ্চারণ অনুসারে বানান তো হবে ‘কোর্‌লো, বোল্‌বো, হোলো, হোতো’।

আর-এক ধরনের বানান পাই ক্রিয়াপদে—পুরবে, চুকবে, মিলবে। এগুলো পুর্‌-বে, না পুরো-বে, চুক্‌-বে না চুকো-বে, বিকবে না বিকোবে? আমার মতে প্রযোজক বা নাম-ক্রিয়ার বানানে এ সব ক্ষেত্রে ও-কার দেওয়াই উচিত।

এখানে লেখার ‘ইকনমি’-র, অর্থাৎ কতটা কম লিখে উচ্চারণ বোঝানো যায়, তার হিসেবটাও এসে যায়। কলকাতা-কে ‘কোলকাতা’ লিখতেই হবে? তা হলে ঘড়ি-কে কেন ‘ঘোড়ি’ লিখি না? আমরা বানান শিখে উচ্চারণ করি, না উচ্চারণ শিখে বানান দেখি? বানান দিয়ে সব উচ্চারণ প্রতিফলিত করা যায় না, তার দরকারও নেই। বিপুলভাবে উচ্চারণ-অসংগত বানান-রীতি সত্ত্বেও ইংরেজ-ফরাসিরা এ নিয়ে আর মাথা ঘামায় না।

আনন্দবাজার আবার মূলধারা থেকে সরে যায় যখন সে অবঙ্গীয় ভারতীয় নাম ও শব্দে তার নিজস্ব বানান, যত দূর শুনেছি দেবনাগরি লেখার হুবহু বঙ্গলিপ্যন্তরে, অনুসরণ করে। এতেও বাঙালির উচ্চারণ আর এই পত্রিকার বানানের একটা স্নায়ুযুদ্ধ দীর্ঘদিন ধরে তৈরি হয়েছে। বিনীত প্রশ্ন, এগুলিকে বাংলা শব্দ ধরে নিয়ে বাংলা উচ্চারণেই লেখা উচিত নয় কি? ‘পাটনা’কে ‘পটনা’ আর ‘অজন্তা’কে ‘অজিণ্ঠা’ কেন লিখব? অন্য দিকে দেবনাগরির ফুটকি আর বাংলার চন্দ্রবিন্দু কোথায় আর কীভাবে এক? ‘গাঁধী’ লেখার যুক্তি আমার কাছে স্পষ্ট নয়।

তিনটি খুচরো প্রসঙ্গ তুলি। ১. আমার কাছে ‘এমনকি’র যুক্তি হল: তা ‘হ্যাঁ-না’ প্রশ্নের সঙ্গে যুক্ত। ‘কি’ ওই প্রশ্নের চিহ্ন। ‘হরভজন সেঞ্চুরি করেছে ? হ্যাঁ, এমনকি হরভজনও সেঞ্চুরি করেছে। না, এমনকি হরভজনও একটা উইকেট পায়নি।’ ‘কী’ যে ধরনের প্রশ্নের সঙ্গে যুক্ত তার উত্তর ‘হ্যাঁ/না’ হয় না। ২. ‘উহ্য’ মানে ‘বহনের যোগ্য’, আর দীর্ঘ ঊ দিয়ে ‘ঊহ্য’ মানে ‘অনুপস্থিত’। ৩. কিছু দিন থেকে ‘আকাঙ্ক্ষা’ আর ‘অদ্রিজা’ বানান ভুল দেখে কষ্ট হচ্ছে। ‘ঙ্ক্ষ’ দিয়ে বাংলায় দুটো-তিনটে শব্দের একই উৎস, আর দ্বিতীয়টার মানে হল ‘অদ্রি’ অর্থাৎ পাহাড়ের (হিমালয়ের) মেয়ে, মানে ‘পার্বতী’।

শেষে অরণ্যে রোদন বা আবেদন। আবার সংবাদপত্রগুলি ও বিদ্বজ্জনেরা সকলে মিলে বাংলা বানানের ভিন্নতা-বর্জনের উদ্যোগ কি নিতে পারেন না, অন্তত ভাবী পাঠক, ছাত্রছাত্রী আর প্রথম শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে? এটা তো দেশপ্রেমের, ভাষাপ্রেমের কাজ। নববর্ষ তো এই সবে চলে গেল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

International Mother Language Day Spelling
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE