বিদেশের মাটিতে বিরোধীপক্ষের প্রতি এবং পূর্ববর্তী মন্ত্রিসভাগুলির প্রতি কটাক্ষও ছুড়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ছবি: পিটিআই।
রাষ্ট্রচালনার জন্য যে সব বইপত্র বা দলিল-দস্তাবেজ রয়েছে, তাতে প্রশাসনিক রীতিনীতি, পদ্ধতি-পক্রিয়া সম্পর্কে অনেক কথাই খুব স্পষ্ট করে লেখা থাকে। কিন্তু অনেক প্রয়োজনীয় কথা আবার লেখা থাকেও না। গণতান্ত্রিক সৌজন্য হল তেমনই এক উপাদান, অত্যাবশ্যক হলেও যার কথা খুব বড় বড় হরফে লেখা থাকে না। সম্প্রতি এই সৌজন্য খুব বিপদেই রয়েছে।
গণতন্ত্রে অংশগ্রহণকারী পক্ষগুলির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবেই। একই সঙ্গে সৌজন্যমূলক সম্পর্কটা থাকাও জরুরি। এই কথাটাই সম্ভবত খেয়াল রাখতে পারছেন না প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
বিদেশ সফরে গিয়ে দেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে মন্তব্য করা খুব পরিণত মনস্কতার পরিচয় নয়। মোদী কিন্তু সেই অপরিণত কাজটাই করেছেন। ওমানে গিয়ে নরেন্দ্র মোদী নিজের মন্ত্রিসভার ভাবমূর্তি সম্পর্কে অনেকগুলো কথাই খরচ করেছেন। তাতেই যদি থেমে যেতেন মোদী, তা হলে খুব আপত্তিকর হয়ে উঠত না দৃশ্যটা। কিন্তু মোদী থামেননি। বিরোধীপক্ষের প্রতি এবং পূর্ববর্তী মন্ত্রিসভাগুলির প্রতি কটাক্ষও ছুড়ে দিয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে এহেন আচরণ প্রত্যাশিত নয়, উল্টোটাই প্রত্যাশিত বরং।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
এই প্রথম বার বিদেশে গিয়ে নরেন্দ্র মোদী প্রথা ভাঙলেন, এমন কিন্তু নয়। আগেও বিদেশ সফরে গিয়ে দেশের রাজনীতি নিয়ে মুখ খুলেছেন তিনি। সেই কারণেই এই অসৌজন্যের বিরুদ্ধে আরও শক্ত করে কলম ধরাটা জরুরি হয়ে পড়ল। নরেন্দ্র মোদী ভুল করে প্রথা ভাঙছেন, এমনটা বোধহয় নয়। তিনি সম্ভবত খুব হিসেব কষেই এই অসৌজন্যটা দেখাচ্ছেন। বার বার এই একই অসৌজন্য দেখিয়ে হয়তো তিনি বুঝিয়ে দিতে চাইছেন, বিদেশের মাটিতে ভাষণ দেওয়ার সময় দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস এড়িয়ে চলাকে তিনি প্রথা বলে মনেই করেন না। কিন্তু এমন কোনও ভাবনা যদি নরেন্দ্র মোদীর থেকে থাকে, তা হলে সে ভাবনা পরিণত গণতন্ত্রের ধারণার সঙ্গে খাপ খায় না।
যে রাষ্ট্রে গণতন্ত্র যত বেশি পরিণত, সেই রাষ্ট্রে রাজনৈতিক লড়াই ততটাই বেশি সৌজন্যের মোড়কে আবৃত। এই সৌজন্যের মোড়কটা কোনও বিলাসিতা কিন্তু নয়। এই মোড়কটা আসলে গণতান্ত্রিক পরিমিতি বোধ এবং গণতান্ত্রিক সুস্বাস্থ্যের সূচক। এই মোড়ক ভারতের রাজনীতিতে নতুন করে আমদানি করতে হচ্ছে, এমন নয়। গত সত্তর বছরের গণতান্ত্রিক অনুশীলন ভারতীয় রাজনীতিকে এই মোড়কে অনেকটাই অভ্যস্ত করে তুলেছিল। এখন বেশ অকারণেই সেই অভ্যাসের বিসর্জনের চেষ্টা দেখতে হচ্ছে।
আরও পড়ুন: ওমান থেকে খোঁচা মোদীর, জানেন না কী বলতে হয়: কংগ্রেস
শুধু বিদেশের মাটিতে নয়, অসৌজন্য দেশেও দেখাচ্ছে মোদীর ব্রিগেড। প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের সময় বিরোধী দল কংগ্রেসের সভাপতি রাহুল গাঁধীকে দর্শকাসনের ষষ্ঠ সারিতে ঠেলে দেওয়া সেই অসৌজন্যেরই নিদর্শন। সংসদের বাজেট অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণের উপর ধন্যবাদজ্ঞাপক বক্তৃতা দেওয়ার সময় নির্বাচনী জনসভার ঢঙে ও রঙে কথা বলাটাও সেই একই অসৌজন্যের নিদর্শন।
গণতন্ত্রে বিরোধী দলের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অনস্বীকার্য। বিরোধী দলের অস্তিত্বকে বা গুরুত্বকে স্বীকৃতি না দেওয়ার মধ্যে কোনও বীরত্ব বা গরিমা নেই। রয়েছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব। শাসক যতটা প্রাসঙ্গিক, বিরোধী দলও যে ততটাই, আন্তর্জাতিক রীতিনীতির দিকে চোখ রাখলেও তা স্পষ্ট বোঝা যায়। মায়ানমারের নেত্রী সু চি যখন ভারতে এলেন, তখন শুধু সরকার পক্ষ নয়, বিরোধী নেত্রী সনিয়া গাঁধীর সঙ্গেও তিনি দেখা করে গেলেন। ভারতের বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ যখন বাংলাদেশে যান, তখন তিনি শুধু প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সঙ্গে কথা বলেই ফিরে আসেন না। দেখা করেন বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গেও। গণতন্ত্রে এটাই দস্তুর। গণতন্ত্র আসলে সকলের অন্তর্ভুক্তির বন্দোবস্ত। যদি কেউ গণতন্ত্রকে ঠিক বিপরীত উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চান, অন্তর্ভুক্তির বদলে বিচ্ছিন্নতার পথে হাঁটতে চান, তা হলে তিনি গণতন্ত্রের অর্থ, ধারণা এবং বোধকে পুরোপুরি হৃদয়ঙ্গম করে উঠতে পারেননি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy