Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

শেষ নাহি যে

কোনও অভিযোগ নথিভুক্ত হইলে যদি দ্রুত তাহার তদন্ত আরম্ভ হয়, প্রমাণাদি সংগ্রহ করা হয়, যদি তদন্তের কাজে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ না ঘটে, যদি বিচারপ্রক্রিয়াটিকে ত্বরান্বিত করা যায়, তাহা হইলে কাজের কাজ হওয়া সম্ভব।

শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৮ ০০:১১
Share: Save:

রাম মাধব আদি বিজেপি নেতারা এখনও আসিফা বানু-কাণ্ড হইতে রাজনৈতিক লাভের কড়ি গনিয়া লইতে ব্যস্ত। সেই সময়, কেন্দ্রীয় মহিলা ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রী মেনকা গাঁধী বলিলেন, অনূর্ধ্ব বারো বৎসরের শিশুর ধর্ষকদের যাহাতে মৃত্যুদণ্ড হয়, তাঁহার দফতর সেই মর্মে পকসো আইনে সংশোধনী আনিবার কথা ভাবিতেছে। শুভবুদ্ধির উদয়? কাঠুয়া-কাণ্ডে দেশব্যাপী বিরূপ প্রতিক্রিয়া সামলাইবার নয়া ফন্দি? দীনদয়াল উপাধ্যায় মার্গে অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ? বিকল্পগুলির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পূর্বে একটি ভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপন প্রয়োজন। প্রাণদণ্ডের ব্যবস্থা কি সত্যই এই ঘৃণ্য অপরাধের প্রবণতা কমাইতে পারে? শিশুদের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের ঘটনার সিংহভাগ ঘটে পরিবারের অভ্যন্তরে। ফলে, অপরাধীকে আড়াল করিবার তাড়নাও বহু ক্ষেত্রেই প্রবল। প্রায় সব রাজ্যের পরিসংখ্যান বলিতেছে, এই ধারায় যত অভিযোগ নথিভুক্ত হয়, বড় জোর তাহার এক-পঞ্চমাংশ ক্ষেত্রে অভিযুক্তের শাস্তি হয়। এবং, বেকসুর খালাস পাইবার প্রধানতম কারণ, শিশুর বয়ান পরিবর্তন। সেই বয়ান কেন বদলায়, অনুমান করিতে মন্ত্রী হওয়ার প্রয়োজন নাই। প্রাণদণ্ডের ব্যবস্থা থাকিলে ছবিটি বদলাইয়া যাইবে, এ হেন আশাবাদের কারণ কী? যদি শিশু নির্যাতনের গণ্ডি ছাড়াইয়া যে কোনও ধর্ষণের কথা ধরা যায়, তবে সেই ক্ষেত্রে প্রাণদণ্ড দেওয়ার অবকাশ আছে। নির্ভয়া মামলায় চার অভিযুক্তের প্রাণদণ্ডেরই আদেশ হইয়াছে। কিন্তু, তাহাতে কি ধর্ষণের সংখ্যা কমিয়াছে? বিকৃতমনস্কদের মনে ভীতির সঞ্চার হইয়াছে? মেনকা গাঁধী, হেমা মালিনীরা উত্তরটি জানেন।

বরং, কোনও অভিযোগ নথিভুক্ত হইলে যদি দ্রুত তাহার তদন্ত আরম্ভ হয়, প্রমাণাদি সংগ্রহ করা হয়, যদি তদন্তের কাজে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ না ঘটে, যদি বিচারপ্রক্রিয়াটিকে ত্বরান্বিত করা যায়, তাহা হইলে কাজের কাজ হওয়া সম্ভব। অল্প কথায় বলিলে, কাঠুয়া-কাণ্ডে বিজেপি যে রাজনৈতিক অবস্থানটি লইয়াছিল, তাহার সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ অবস্থানটি জরুরি। অপরাধ ও শাস্তির মধ্যে ভারতে যে দুস্তর দূরত্ব রহিয়াছে, তাহা কমিয়া আসিলে সম্ভাব্য অপরাধীরা জানিবে, নিস্তার নাই। মেনকা গাঁধীরা কি জানেন যে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করা অসম্ভব? ধর্ষকদের রক্ষা করিতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কোনও মতেই বন্ধ হইবে না? সেই জ্ঞানই কি তাঁহাদের প্রাণদণ্ডের পক্ষে সওয়াল করিতে বাধ্য করিতেছে? অনুমানটি যদি সত্য হয়, তবে মেনকা গাঁধীর বিবৃতিকে পরাজয়ের স্বীকারোক্তি হিসাবে দেখাই বিধেয়। রাজনীতির চাপের নিকট প্রশাসনিকতার পরাজয়ের স্বীকারোক্তি। তিনি জানাইয়া দিলেন, যতই ২০১৪ সালের নির্বাচনের পূর্বে মহিলাদের জন্য নিরাপদ দেশ গড়িয়া তুলিবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হউক, যতই ‘বেটি বচাও, বেটি পঢ়াও’ বলিয়া প্রধানমন্ত্রী হুঙ্কার দিন, রাজনীতির সমীকরণের নিকট ভারতে মহিলা-শিশুদের নিরাপত্তার প্রশ্নটি অকিঞ্চিৎকর।

অতঃপর, পড়িয়া থাকে একটিই সম্ভাবনা— বিজেপি বিরুদ্ধ জনমতকে বাগে আনিবার চেষ্টা করিতেছে। ভারতে কেন, সম্ভবত গোটা দুনিয়াতেই জনতা তাৎক্ষণিক বিচারে বিশ্বাসী। ধর্ষণ হইতে সন্ত্রাসবাদ, যে কোনও প্রশ্নেই কার্যত বিনা বিচারে ফাঁসি দেওয়ার রায় দিয়া থাকে জনতা। কাঠুয়া-কাণ্ডেও তাহাই হইতেছে। অনুমান করা চলে, মেনকা গাঁধী সেই সুরে সুর মিলাইয়া নিজেকে, এবং দলকে, জনমতের সহিত এক বিন্দুতে প্রতিষ্ঠা করিতে উদগ্রীব। সাইবার সেনারা আরও সুর চড়াইবে, এবং সেই নিনাদে ঢাকা পড়িয়া যাইবে কাঠুয়া-কাণ্ডে বিজেপির ন্যক্কারজনক ভূমিকা। জনতার অবিবেচনাপ্রসূত মতকেই সরকারি মতের তকমা দেওয়ার চেষ্টা প্রশাসনিকতার ধর্ম হইতে আরও এক দফা বিচ্যুতি। বিজেপি যে কোথায় থামিবে, অনুমান করা দুষ্কর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Maneka Gandhi BJP Lea Asifa Bano Rape
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE