Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

স্বাধীনতার সীমা

বাক্‌স্বাধীনতা বস্তুটি শুনিতে ভারী সহজ। কিন্তু বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে এই নীতি যে পরিমাণ ঘোল খাওয়াইয়া থাকে, তাহার হিসাব লইতে গেলে মাথা ঘুরিয়া যাইবার জোগাড়।

শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০১৭ ০০:৩৮
Share: Save:

বাক্‌স্বাধীনতা বস্তুটি শুনিতে ভারী সহজ। কিন্তু বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে এই নীতি যে পরিমাণ ঘোল খাওয়াইয়া থাকে, তাহার হিসাব লইতে গেলে মাথা ঘুরিয়া যাইবার জোগাড়। বাক্য কহিবার স্বাধীনতা যদি পূর্ণ মাত্রায় প্রদত্ত হয়, তবে কি যে কোনও বাক্য যে কাহারও উদ্দেশ্যে উচ্চারণ করা যায়? সে বাক্য যদি অত্যন্ত ঘৃণাপূর্ণ এবং আক্রমণাত্মক হয়, তাহা হইলেও? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই ফাঁদে পড়িয়া হাবুডুবু খাইতেছে, ব্রিটেনও, ফ্রান্সও। এবং ভারতও। ভারতের সর্বোচ্চ আদালত এই সে দিন পাঁচ-বিচারকের বেঞ্চের নিকট একটি বিবেচ্য প্রশ্ন পাঠাইয়াছে যে, সংবিধানে যে বাক্‌স্বাধীনতার নীতিটি স্বীকৃত হইয়াছে, তাহার ক্ষেত্রে একটি শর্ত আরোপের দরকার আছে কি না যে— উদ্দিষ্ট ব্যক্তির মর্যাদাহানিকর ‘বাক্য’-এর ক্ষেত্রে এই স্বাধীনতা প্রযোজ্য নয়? মহামান্য বিচারপতিরা আপাতত বিষয়টির আলোচনা করিতেছেন, কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছান নাই, বস্তুত ইতিহাস ও দর্শনের ভিত্তিতে বিচার করিলে সিদ্ধান্তে পৌঁছনো মোটেই সহজ কাজ নয়। কিন্তু এই অবকাশে লক্ষণীয়, তর্কটি কত গুরুতর, জটিল এবং বিপদসঙ্কুল, এবং সামাজিক অগ্রগতি (বা পশ্চাৎগতি) কতটাই এই প্রশ্নের উত্তরের উপর নির্ভরশীল।

প্রশ্নটি উঠিয়াছে উত্তরপ্রদেশের একটি ঘটনার সূত্র ধরিয়া। বুলন্দশহর অঞ্চলে এক দরিদ্র নারী ও তাঁহার কিশোরী কন্যাকে আট জন মিলিয়া গণধর্ষণের পর ছাড়িয়া দিলে তাঁহাদের পরিবার যখন মামলা করে, সেই মামলার সূত্রে পূর্বতন সমাজবাদী পার্টির সরকারের জনৈক মন্ত্রী আজম খান প্রকাশ্যে ধর্ষণের ঘটনা অস্বীকার করেন, এবং ওই দুই নারী বিষয়ে অসম্মানকর মন্তব্য করেন। অভিযুক্তের অভিযোগ প্রমাণিত হইবার আগেই এই ভাবে তাঁহাদের মর্যাদাহনন কি মন্ত্রীর বাক্‌স্বাধীনতার অধিকারের মধ্যেই পড়িবে তাহা হইলে?— এই হইল প্রশ্ন। যদিও প্রতিবাদ প্রতিরোধের (এবং দলীয় রাজনৈতিক সংকটের) মুখে পড়িয়া মন্ত্রী ইতিমধ্যেই সুপ্রিম কোর্টে ক্ষমাপ্রার্থনা করিয়াছেন, তবু বিষয়টি বিচারকরা তুলিয়া লইয়াছেন একটি নীতিগত সংকট হিসাবে। বিচারব্যবস্থাকে ধন্যবাদ, এমন একটি অতি দূরদৃষ্টিপূর্ণ পদক্ষেপের জন্য: সত্যই এই জটিল প্রশ্নের সন্তোষজনক কিছু বিচার-সূত্র থাকা দরকার। মন্ত্রী যাহা বলিয়াছেন, তাহা অতি অসঙ্গত, অনৈতিক সন্দেহ নাই, কিন্তু আইন করিয়া ‘মর্যাদা’ নামক বাক্‌স্বাধীনতার সীমা তৈরি করিয়া দিলে ভবিষ্যতে সেই ‘সীমা’র বহু অপব্যবহারও সম্ভব। কাল্পনিক চরিত্রের অমর্যাদা হইতেছে এই অভিযোগে মেঘনাদকাব্য-রচয়িতার প্রতিও ঝাঁপাইয়া পড়া সম্ভব। অসহনশীলতার মারণব্যাধি যখন এমনিতেই ভারতীয় সমাজকে গ্রাস করিতে বসিয়াছেন, তখন বাক্‌স্বাধীনতায় ‘মর্যাদা’ নামক সীমা আরোপ কিন্তু পরিস্থিতি আরও কঠিন করিয়া দিতে পারে, অসহিষ্ণুতার মাত্রা আরও কয়েক দাগ চড়াইয়া দিতে পারে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ‘ইসলামোফোবিয়া’র সূত্রে একই বিতর্ক এখন প্রবল। অনেকেই যুক্তি দিতেছেন, ‘ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্ট’ যেহেতু মার্কিন সংবিধানের প্রধান চরিত্রনির্ধারক স্তম্ভ, বাক্‌স্বাধীনতার নূতন সীমা তৈরির বদলে বরং সংবিধান-অনুমোদিত অন্যান্য নীতির মানদণ্ডে বাক্‌স্বাধীনতার নীতিটিকে মিলাইয়া লওয়া হউক, যেমন: হিংসা উদ্রেককারী কথা বা কাজ আটকানো ইত্যাদি। ভারতও আইন দিয়া বাক্‌স্বাধীনতা মর্যাদা শর্ত আরোপের বদলে চেষ্টা করিতে পারে মর্যাদাকে একটি পার্শ্বনীতি হিসাবে দেখিতে। তবে কি না, প্রতি দেশেরই বিশিষ্ট প্রেক্ষিত থাকে, বিচারপদ্ধতিতে যাহা অতি জরুরি। ভারতে যেহেতু নারী-বৈষম্য, নারীনির্যাতন একটি দৈনন্দিন ভয়ংকরতা, নারীর মর্যাদা আলাদা একটি পার্শ্বনীতি হিসাবে বিচারকদের বিবেচনায় থাকা উচিত। আইন হিসাবে নয়, বিচারের প্রেক্ষিত হিসাবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Boundaries Freedom of Speech
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE