Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

রক্তাক্ত সন্ধান

লন্ডন সন্ত্রাস একটি প্রশ্নের উত্তর সন্ধান অত্যন্ত জরুরি করিয়া তুলিল। সন্ত্রাসবাদীরা যদি নির্বিচারে মানুষ মারিয়া সর্বাত্মক ত্রাস-পরিবেশ তৈরি করিতে চায়, তবে তাহার প্রতিক্রিয়া কেমন হওয়া উচিত?

শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

লন্ডন সন্ত্রাস একটি প্রশ্নের উত্তর সন্ধান অত্যন্ত জরুরি করিয়া তুলিল। সন্ত্রাসবাদীরা যদি নির্বিচারে মানুষ মারিয়া সর্বাত্মক ত্রাস-পরিবেশ তৈরি করিতে চায়, তবে তাহার প্রতিক্রিয়া কেমন হওয়া উচিত? মানুষ কি ত্রস্ত হইবেন, ভয়ে গুটাইয়া গিয়া স্বাভাবিক জীবনযাপনে পরাঙ্মুখ হইবেন? যুক্তি বলিতেছে, সে ক্ষেত্রে জঙ্গিরা সর্বতোভাবে সফল হইবে, তাহাদের লক্ষ্য পূর্ণ হইবে। নাকি— মানুষ ভয় না পাইয়া স্বাভাবিক জীবনে নিয়মিত ছন্দে পা ফেলিতে থাকিবেন? সে ক্ষেত্রে জঙ্গিদের একটি উদ্দেশ্য অন্তত ব্যর্থ হইবে, ত্রাসের পরিবেশ নির্মাণের লক্ষ্যটি সিদ্ধ হইবে না। কিন্তু উলটা বিপদও আছে। মনে হইবার অবকাশ আছে যে, বর্বরোচিত আক্রমণে কিছু সংখ্যক জীবন অকালে ঝরিয়া গেলে বিশ্বপৃথিবীর যেহেতু তত কিছু আসিয়া যায় না, আক্রমণ আরও ভীষণতর, ব্যাপকতর, বহুলতর হওয়া দরকার। বিশেষত সন্ত্রাসের জন্য যখন কয়েকটি ছুরি এবং একটি ট্রাক ছাড়া তেমন কিছুই লাগে না, একটি জীবন লইলেই যেহেতু কোনও জঙ্গি ‘যোদ্ধা’ ও ‘শহিদ’ হইয়া যায়, তাই মানবনিধন আরও লাগাতার ও প্রাত্যহিক হওয়া ভাল।

লন্ডন কাণ্ডের পর প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে কিংবা মেয়র সাদিক খানের মন্তব্য লইয়া বিতর্কের ঝড় এই প্রশ্নের ভবিতব্যতাটিকেই তুলিয়া ধরে। টেরেসা মে ব্রিটিশ নাগরিকদের শান্ত থাকিতে বলিবার পরিবর্তে তীব্র ভাষায় সন্ত্রাসের মোকাবিলার কার্যক্রম তৈরির কথা বলিয়াছেন। তাঁহার বিতর্কিত বাক্য ‘এনাফ ইজ এনাফ’, তাঁহার ইন্টারনেট নজরদারির নির্দেশ ইত্যাদির মধ্যে কর্তৃত্ববাদী হস্তক্ষেপের স্পষ্ট ছায়া। এই কঠোরতার ইশারা দেখিয়া অনেকেই বলিতেছেন, ইহার মধ্যে জঙ্গি মুসলিম বিরোধিতার সূত্রে সামাজিক বিভাজন বাড়াইবার অশনিসঙ্কেত। ইহার অপেক্ষা বরং স্বাভাবিকতা রক্ষার আহ্বান প্রচার করিলেই প্রধানমন্ত্রী ভাল করিতেন। আবার, বিপরীতে, মেয়র সাদিক খান যখন প্রশাসনিক তৎপরতা বাড়াইবার সঙ্গে সঙ্গে নাগরিকদের আতঙ্কগ্রস্ত হইতে বারণ করিলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হইতে শুরু করিয়া কনজারভেটিভ ব্রিটিশ নেতৃবর্গ, সকলে খেপিয়া গেলেন। তাঁহাদের বক্তব্য, একের পর এক ভয়ঙ্কর আক্রমণের পরও কোন মুখে কোনও নেতা মানুষকে আতঙ্কিত বোধ না করিতে বলেন? ঘটনা হইল, টেরেসা মে, সাদিক খান দুই জনেই সন্ত্রাস-পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার অবশ্যম্ভাবী দ্বন্দ্বটির সঙ্গেই লড়াই করিতেছেন, তাই তাঁহাদের একতরফা অভিযোগের লক্ষ্য করা উচিত নহে। ভয় নিশ্চয়ই কাজের কথা নয়। তেমনই, ম্যাঞ্চেস্টার ও লন্ডনের পর ভয় না পাওয়াটাও নাগরিকের পক্ষে অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ে।

লিবারাল ব্রিটিশ প্রচারমাধ্যমগুলি ভুল বলে নাই, নির্বাচনের মাত্র কয়েকটি দিন বাকি, তাই টেরেসা মে-র দৃঢ় প্রশাসনিক মুখটির পিছনে একটি হিসাব কাজ করিতেছে। পরিস্থিতির সুযোগ লইবার হিসাব। তবে কিনা, তাঁহার প্রতিক্রিয়াকে সম্পূর্ণ ভাবে রাজনৈতিক অভিসন্ধিপ্রসূত রূপে দেখাও ঠিক নয়। মানিতে হইবে, ভোট অতিক্রম করিয়াও ইহা একটি গভীরতর প্রশ্ন। ব্রিটিশ সমাজ ও রাজনীতি অনেক দিন ধরিয়া বহুসংস্কৃতির পক্ষে লড়াই চালাইতেছে, অভিবাসী, ভিন্-সংস্কৃতি, ভিন্-ধর্মের নাগরিকদের জন্য দেশের সমাজকে যথেষ্ট খোলা রাখিয়াছে। এক দিকে এই উদার বহুত্ববাদী অবস্থান, অন্য দিকে বর্বরোচিত আক্রমণ: এই জাঁতাকলে আজ সমাজের একটি বড় অংশ অসহিষ্ণু, দিশাহারা। ব্রেক্সিট নিশ্চয়ই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। কিন্তু কোন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সেই দুর্ভাগ্য তৈরি হইয়া উঠিল, তাহাও বোঝা জরুরি। নতুবা, রক্ষণশীলতার বিপরীতে রক্ষণশীলতা আরও বাড়িয়া চলিবে। উপর্যুপরি জঙ্গি হানায় বিধ্বস্ত ব্রিটেন আজ সেই দ্বন্দ্বটিতেই জেরবার হইতেছে। দৃঢ়তা, না নমনীয়তা, এই লাগাতার অসহিষ্ণুতার মোকাবিলা কোন পথে করা সঙ্গত?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

British society politics multiculturalism
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE