Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

ক্ষমতা হারানোর ভয় ঢুকছে, সিবিআই আশ্রয়ই ভরসা

নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই গিয়েছিলাম ৭ নম্বর রেসকোর্স রোডে। বিবেক দেবরায়ের সম্পাদিত একটি বইয়ের আনুষ্ঠানিক প্রকাশ ছিল সে দিন।

বিরোধিতার মুখ। রাহুল গাঁধী ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, দিল্লি। পিটিআই

বিরোধিতার মুখ। রাহুল গাঁধী ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, দিল্লি। পিটিআই

জয়ন্ত ঘোষাল
শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই গিয়েছিলাম ৭ নম্বর রেসকোর্স রোডে। বিবেক দেবরায়ের সম্পাদিত একটি বইয়ের আনুষ্ঠানিক প্রকাশ ছিল সে দিন। অনুষ্ঠানের পর চা-চক্রে মোদীকে প্রশ্ন করলাম, মুখ্যমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রী হয়ে নিজেকে কি এ বার একটু অন্যরকম লাগছে? গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর নিবাসে এত ময়ূরের ডাক শোনা যেত না! পিঠে একটা সজোর থাপ্পড় মেরে মোদী বলেছিলেন, ‘‘ভালো করে আমাকে দেখো। কোনও পরিবর্তন কি নজরে পড়ছে? আর যদি মনে হয়, এই কদিনেই আমি বদলে গিয়েছি, তাহলে বলব জয়ন্ত্ তোমার চোখের সমস্যা হচ্ছে! ভাল চোখের ডাক্তার দেখাও।’’

কিছুদিন পর আবার দেখা হল সংসদে। সে দিনও তিনি বলেছিলেন, ভোটের সময় অনেক তর্কবিতর্ক হয়। কিন্তু এখন ভোটের পর একটা টিম তৈরি করে দেশের কাজ করতে হবে। তাতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভাও থাকবেন, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরাও থাকবেন। মোদীর মোদ্দা কথা ছিল—‘কিসিকে সাথ হামারা কোই দুশমনি নেহি হ্যায়।’

এর কিছুদিন পরেই দেখলাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ অনুগামী রাজ্যসভার সাংসদ মুকুল রায়ের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়ে গেল। শুধু মুকুল নয়, আরও কয়েক জন নেতাকে এক দিকে আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ অন্য দিকে সিবিআই ডাকাডাকি শুরু করে দিল। কোনও এক জন সাংসদকে নোটিস পাঠানো, সিবিআই কর্তাদের ডাকা মানেই আজকাল সেটা সংবাদমাধ্যমের একটা বড় ‘ইভেন্ট’। বফর্স অথবা হাওয়ালা কেলেঙ্কারির তদন্তের সময়ে ইলেকট্রনিক আর সোশ্যাল মিডিয়ার এই দাপট ছিল না। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের মুখেই নারদা টেপের বিষয়টির আত্মপ্রকাশও যে এই মমতা-বিরোধী রাজনীতির কৌশলের অন্যতম অঙ্গ ছিল, তা নিয়ে আমার মনে সামান্যতম সন্দেহও নেই। কারণ সে সময়ে বেশ কিছু বিজেপি নেতা আমাকে প্রবল উল্লসিত হয়ে আগাম জানিয়ে দিতেন এরপর কাকে সিবিআই এসব নিয়ে নোটিস পাঠাবে। সিবিআই-এর বেশ কিছু অফিসারের সঙ্গে কিছু বিজেপি নেতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও দেখেছি।

আমি দুর্নীতিকে কখনওই সমর্থন করছি না। যদি তৃণমূলের কোনও নেতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠতমও হন, দুর্নীতি প্রমাণিত হলে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চয়ই নিতে হবে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর ছেলে সঞ্জয় গাঁধীর বিরুদ্ধেও ‘কিস্সা কুর্সি কা’ ছবির প্রিন্ট জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য ষড়যন্ত্র মামলায় সিবিআই ১৯৭৭ সালে মোরারজি সরকার গঠনের পর চার্জশিট জারি করে। নিম্ন আদালত দোষী সাব্যস্ত করলেও সুপ্রিম কোর্ট এই অভিযোগ নস্যাৎ করে দেয়।

কিন্তু তদন্ত কি তদন্তের স্বার্থে হয়েছিল সে দিন? আজ মোদীর নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে মমতা মুখর। দেশ জুড়ে তিনি মোদীবিরোধী রাজনীতির অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠেছেন। প্রায় দু’দশক পর আবার মমতা এবং কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের নৈকট্য বাড়ছে। রাহুল-মমতা নয়া জুটি গড়ে উঠছে ভারতীয় রাজনীতিতে। বিগত সংসদীয় অধিবেশন চলেনি। বাজেট অধিবেশনেও প্রবল ঝড়ঝঞ্ঝার সম্ভাবনা। ঠিক এমন এক সময়ে সিবিআই যেভাবে তাপস পালকে গ্রেফতার করল, যে ভাবে বেশ কিছু সাংসদ, এমনকী রাজ্যের মন্ত্রীদেরও একে একে ডাকার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে, তা দেখে কি মনে হচ্ছে না সিবিআই-এর এই অভিযানের পিছনে আছে রাজনৈতিক রণকৌশল? আর যে নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, তিনি বদলাবেন না, কোনও ‘দুশমনি’ দেখাবেন না– এই ঘটনা কি তার বিপরীত সত্যকেই প্রতিষ্ঠিত করছে না? যাকে এক কথায় বলা যায় ব্ল্যাকমেলের রাজনীতি?

শুধু মমতা একা নন, বিরোধী শিবিরকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য ভোটের মুখে মায়াবতীর ভাইয়ের বিরুদ্ধেও তদন্ত শুরু হচ্ছে। মুলায়ম সিংহ যাদব যাতে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট না বাঁধেন তার জন্য বহু প্রাচীন আয়ুর্বেদ মামলাকে আবার অক্সিজেন জোগানো হচ্ছে। মুলায়মকে ভয় দেখানো হচ্ছে একই ভাবে। কিছুদিন আগে দিল্লি থেকে প্লেনে কলকাতায় যাচ্ছিলাম। সহযাত্রী ছিলেন অমর সিংহ। অমর সিংহ বলেছিলেন, ‘‘জানেন তো সিবিআই তদন্তগুলির মৃত্যু হয় না। ফাইলে থেকেই যায়। রাজনৈতিক প্রয়োজনে ও শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে এই তদন্তগুলি কখনও ফাইল থেকে বেরিয়ে পড়ে, আবার কখনও ফাইলবন্দি হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আপনি বন্ধুত্ব করুন, কোনও চিন্তা নেই! শত্রুতা করলেই কিন্তু বহুৎ মাহেঙ্গা পড়েগা!’’ পোড় খাওয়া অমর সিংহ নিজে বহু মামলা সামলেছেন, তাই তিনি যা বলছেন, তা একদমই নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই।

তা ছাড়া ভারতের ইতিহাসে সিবিআইকে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করাটা তো কোনও নতুন ঘটনা নয়। বার বার নানা সময়ে নানা দলের নানা প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও সিবিআই তদন্ত বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে। কিন্তু অনেকেই জানেন না, সিবিআইয়ের বিধিতে স্পষ্টভাবে লেখা আছে যে প্রধানমন্ত্রীকে সিবিআই কোনও তদন্ত রিপোর্ট পাঠাবে না এবং জানাবে না। অর্থাৎ সিবিআইয়ের সব রিপোর্ট প্রধানমন্ত্রীর দেখতে চাওয়াও বেআইনি। কিন্তু আমাদের দেশে একটা বাচ্চা ছেলেও জানে যে, বাস্তবে হয় ঠিক উল্টো। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছাড়া সিবিআই এক পা-ও চলে না। বার বার বিভিন্ন প্রধানমন্ত্রী প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্যই সিবিআই-কে ব্যবহার করেছেন। আজ পর্যন্ত কোনও সিবিআই তদন্তে কোনও ভিভিআইপি-র শাস্তি হয়েছে? কোনও তদন্ত কি চূড়ান্ত প্রমাণ অবধি পৌঁছিয়েছে ? বফর্স তদন্ত প্রমাণ হল না, কিন্তু দেশের একটা লোকসভা নির্বাচন হয়ে গিয়েছিল বফর্স নামের শব্দব্রহ্মে ভর করে। রাজনৈতিক প্রচারের কুজ্ঝটিকায় আমজনতা এক বারও জানতে চায়নি তৎকালীন অর্থমন্ত্রী বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহ কেন বফর্স ডিল-এ অনুমোদন দিয়েছিলেন। নরসিংহ রাও হাওয়ালা অস্ত্রে লালকৃষ্ণ আডবাণীকে বধ করেন। সেই তদন্তও কিন্তু শেষ হয়নি, মাঝখান থেকে যে আডবাণী সে দিন প্রধানমন্ত্রী পদের প্রার্থী ছিলেন, জীবনে তাঁর আর প্রধানমন্ত্রী হওয়া সম্ভব হল না। ফডার দুর্নীতির মামলা এখনও প্রমাণ হয়নি। লালুপ্রসাদের মুখ্যমন্ত্রিত্ব কিন্তু গিয়েছে।

নরেন্দ্র মোদী নিজে ভোট প্রচারের সময় অভিযোগ করতেন সিবিআই হল কংগ্রেস ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন। তিনি নিজেও গোধরা কান্ডে সিবিআই-এর তদন্তজালে অভিযুক্ত হন। আর আজ সেই নরেন্দ্র মোদী পুরনো অভিযোগ ভুলে গিয়ে সিবিআইকে-ই মমতা-বধ যজ্ঞের প্রধান অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে চাইছেন কেন?

এটা কি মোদীর রাজনৈতিক কর্তৃত্বের ক্রমবর্ধমান দুর্বলতার পরিচয় নয়? এক প্রবীণ কংগ্রেস নেতা বলছিলেন, সাপ অনেক সময় ভয় পেয়ে কামড়ায়। আড়াই বছর পর এখন মোদীর মনেও ক্ষমতা হারানোর ভয় ঢুকেছে। মমতা-রাহুল জুটিকেও আসলে তিনি ভয় পাচ্ছেন। আর তাই মমতার ঘনিষ্ঠ নেতাদের, এমনকী তাঁর ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কেও রাজনৈতিক টার্গেট করার চেষ্টা করছেন।

আর এই তদন্ত অভিযানের পাশাপাশি অন্য দিকে মমতা যখন দিল্লি আসেন, তখন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন প্রধানমন্ত্রীর সচিব, পশ্চিমবঙ্গের কাডারের অফিসার ভাস্কর খুলবে। মোদী-মমতা সংঘাত যাতে কেন্দ্র রাজ্য সাংবিধানিক সম্পর্কের সুতোটাকে ছিন্ন না করে সেটাই লক্ষ্য। তা না হলে উন্নয়ন ব্যাহত হবে যে। প্রয়াত অতুল্য ঘোষের ঘনিষ্ঠ এক প্রয়াত বাঙালি সাংবাদিক একদা আমাকে বলেছিলেন, ‘‘এই নীতিটাকে কী বলে জানো। বলে রাবড়ি প্রক্রিয়া! নীচে গনগনে আগুন। উপরে ঠান্ডা বাতাস।’’ সমস্যা হচ্ছে মমতা মমতাই। তিনি মুলায়ম, মায়াবতী বা বীরভদ্র সিংহ নন। মমতার অনেক সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, তিনিও রক্তমাংসের মানুষ, কিন্তু ঈশ্বর ওঁকে এক প্রবল সাহস দিয়েছেন। সিবিআইয়ের হুমকিতে ভয় পাওয়া তো দূরের কথা, মমতা যে আরও আহত বাঘিনী হয়ে রণচন্ডীর মূর্তি ধারণ করতে পারেন, সেটা বুঝতে পারছেন না মোদী।

এখনও সময় আছে। মোদীকে বলব, নতুন ভারত নির্মাণের কথা যখন বলছেন, তখন এই সুপ্রাচীন সামন্ত-মানসিকতা উৎসারিত সিবিআই-অস্ত্র অপব্যবহারের রাজনীতি বন্ধ করুন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE