আত্মঘাত: তীব্র প্রতিবাদের দরকার আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু কখন, কোথায়, কতটা, কী ভাবে? কলকাতার একটি স্কুলের সামনে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
স্কুলে ছাত্রীদের ওপর যৌন নিগ্রহের নানা অভিযোগ নিয়ে এখন আবহাওয়া বেশ উত্তপ্ত। অভিযোগগুলি খুবই উদ্বেগজনক, বিশেষ করে অভিভাবকদের পক্ষে। কারও মেয়ের এমন অভিজ্ঞতা হলে অভিভাবকের পক্ষে মাথা ঠিক রাখা খুব কঠিন। ক্ষোভ আপনাআপনিই ফেটে বেরিয়ে আসবে। সেই ক্ষোভে অন্য অভিভাবকরা যোগ দেবেন, এটাও স্বাভাবিক। কারণ আজ না হয় কাল তাঁদের মেয়েরও একই অবস্থা হতে পারে। অন্তত সেই ভয় থাকবেই। তাই দোষারোপ চলবে, জবাবদিহি চাওয়া হবে স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে, উত্তেজনা চড়বে।
বেশ। কিন্তু স্কুলে-স্কুলে এমন ঘটনার পর উত্তেজনার যে প্রকাশ দেখা গিয়েছে, তা কি সর্বদা খুব শোভন, শালীন, যুক্তিসংগত? যৌন হেনস্তার গুরুত্বকে ছোট করে দেখার কোনও প্রশ্নই নেই। অপরাধীর কঠোর শাস্তি পাওয়া অত্যন্ত জরুরি, সেটাও বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রশ্নটা হচ্ছে বাঁধনছাড়া প্রতিবাদের ধরন নিয়ে। মেয়ে নিগৃহীত হলে শোভন আচরণের কথা মা-বাবার মাথায় না-ই থাকতে পারে, কিন্তু বাকি যাঁরা সঙ্গ দিয়েছেন, তাঁরাও কি তাঁদের বোধবুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছেন? তাঁরা অনেকেই যে রণমূর্তি ধরেছেন, যে ভাষায় কথা বলেছেন, যে আচরণ প্রদর্শন করেছেন, তা কি সমীচীন? ‘আমাদের হাতে ছেড়ে দিন, চাবকে মেরে ফেলব’— এ ধরনের মনোবৃত্তির সঙ্গে গণপিটুনির মানসিকতার কিন্তু মৌলিক কোনও পার্থক্য নেই। মনে রাখতে হবে, এখনও সব অভিযুক্তের অপরাধের প্রমাণ মেলেনি, যেটুকু বা মিলেছে তারও সত্যতা নিয়ে সন্দেহ আছে। তা হলে আর হরিয়ানার খাপ পঞ্চায়েত কী দোষ করল?
অন্য একটা প্রশ্নও ওঠে। ভদ্রতার খাতিরে না হোক, তর্কের খাতিরে না হয় ধরে নেওয়া গেল যে, স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এমন আচরণই ঠিক, প্রতিবাদ এ-ভাবেই করতে হয়। কিন্তু এক দল মানুষের কথা আমরা বেমালুম ভুলে গেলাম, যারা তাদের চোখের সামনে এই ডামাডোল, এই সব সাংঘাতিক ঘটনা, এই দোষারোপ, পালটা দোষারোপ, এই রোষ, এই লাগামছাড়া চিৎকার দেখছে, শুনছে এবং কিছুটা অপরিণত মস্তিষ্কে নিজের মতো করে একটা ছবি তৈরি করে নিচ্ছে, নিজের মনের মতো একটা ধারণা বানিয়ে নিচ্ছে। তারা স্কুলের পড়ুয়ারা, মা-বাবার সন্তানেরা। প্রতিবাদের শোরগোলে আমরা কেউ একটি বারও ভেবে দেখছি না যে, ওই শিশুরা গোটা ব্যাপারটাকে কী ভাবে দেখছে, তাদের মনে এই ঘটনাবলির কী প্রতিক্রিয়া ঘটছে। আমরা আসলে ধরে নিচ্ছি তারা অদৃশ্য। তাই, একটি বার গভীরভাবে ভাবা দরকার, শিশুদের জন্য ন্যায় চাইতে গিয়ে আমরা তাদের প্রতিই অন্যায় করছি না তো?
শিশুদের সুরক্ষা তো নিশ্চয়ই প্রয়োজন। বাড়িতেও যেমন প্রয়োজন, স্কুলেও তেমনই। বিশেষ করে স্কুলে বেশি প্রয়োজন, কারণ দিনের অনেকটা সময় শিশুরা স্কুলেই থাকে, সেখান থেকেই তাদের জীবন গঠনের শুরু। তাদের সুরক্ষার জন্যই তো এতটা লড়াই। কিন্তু তৎক্ষণাৎ সুরক্ষার দাবি আদায়ের তাড়ায় যে পন্থা গ্রহণ করা হল, তা মানসিক ভাবে এই শিশুগুলিকে অরক্ষিত করে দিচ্ছে হয়তো, এবং আমরা তা মোটেই ভাবতে রাজি নই। প্রথমেই মাথায় রাখা দরকার, আমাদের এই আচরণ কিন্তু তাদের স্বভাবে ও আচরণে প্রতিফলিত হবে ভবিষ্যতে। কারও আচরণে স্পষ্ট, কারও আচরণে অস্পষ্ট। তাদের মানসিক স্বাস্থ্য শক্তপোক্ত হবে না। আর তখন নিজেদের প্রশ্ন করতে হবে, আমরা কতটা দায়ী এর জন্য।
হতে পারে, এখনকার এই চরম উত্তেজনা, ক্ষোভ, ঘৃণার প্রকাশ দেখে ওরা ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে, ভাবছে কী এমন হল যার জন্য এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে! বিশেষ করে কম বয়সের মেয়েরা। তাদের নিশ্চয়ই মনে হচ্ছে, আমরা মেয়েরা কেমন প্রাণী, যার জন্য স্কুলে এসে মা-বাবারা এমন আচরণ করছে! যে মেয়ের সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটেছে, সে তো বটেই, তার বন্ধুরাও ভাবছে, এমন কী হল যে স্কুলের ভেতরে-বাইরে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে! তারা পরিষ্কার করে বুঝতে পারছে না, কিন্তু এই পরিস্থিতি তাদের মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দিচ্ছে ভয়, অবিশ্বাস। নিজেকে নিয়ে তারা ত্রস্ত হয়ে পড়ছে, নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ব্যাপারটা খতিয়ে জানতে চাইছে। কিছুটা জানছে, বাকিটা ধোঁয়াশা।
অভিভাবকরা হয়তো চেষ্টা করছেন ধোঁয়াশা কাটাতে। শিশুদের গুড টাচ-ব্যাড টাচ শেখাতে তৎপর হচ্ছেন তাঁরা অনেকেই। তার হয়তো খুবই প্রয়োজন রয়েছে। হয়তো ব্যাড টাচ চিনে কোনও একটি মেয়ে স্কুলের শিক্ষিকা বা অভিভাবককে জানাল, যাতে তাঁরা ঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। মেয়েটিকে রক্ষা করতে পারেন। মেয়েটি যদি ব্যাড টাচের বিরুদ্ধে সরব হয়, সে-ও বাঁচতে পারে হয়তো বিপদ থেকে। কিন্তু পাশাপাশি আর একটা কথাও মনে রাখতে হবে। এই ছোট্ট মেয়েটি কিন্তু একটা সময় আর ছোট থাকবে না। এই গুড টাচ ব্যাড টাচের কথা তার মনের মধ্যে ঘুরতেই থাকবে। তার মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক থাকবে তো? সে ক্রমশ পুরুষের প্রতিই অবিশ্বাসী হয়ে উঠবে না তো? পুরুষ দেখলেই— সে যে বয়সের, যে মানসিকতারই হোক— গুটিয়ে যাবে না তো? কিংবা পুরুষ জাতিকেই শত্রু ঠাওরে নেবে না তো?
অন্য একটা বিপদও আছে। এক বারও কি ভেবে দেখা হয়েছে, এই প্রতিবাদ, বিপুল উত্তেজনা, বিরাট শোরগোল, এ-সবই একটা ছোট মেয়ের মনে এই ধারণা ঢুকিয়ে দিতে পারে যে— আমার কিছু হলেই গোটা পৃথিবী এমন ভাবে খেপে উঠবে এবং কোনও কথা না শুনে ‘দুষ্টু লোক’কে মারতে আস্তিন গোটাবে? এই ধারণা নিয়েই সে বড় হবে? এটা কি স্বাভাবিক ভাবে বড় হয়ে ওঠার পদ্ধতি? সাধারণ সমাজে, সাধারণ ভাবে বেড়ে ওঠা, গড়ে ওঠার ঘোর বিরোধী এই মনোভাব। কারণ এই মনোভাব থেকে শিশু হয়তো নিজেকে একটা অস্বাভাবিক গুরুত্ব দিতে শিখবে। এতটাই সেই গুরুত্ব যে, তার সামনে যুক্তি, বুদ্ধি, সব কিছু তুচ্ছ হয়ে যায়।
বাইরের পৃথিবীটা কিন্তু বড়ই কঠিন। যে-মুহূর্তে ছোট্ট মেয়ে একটু বড় হয়ে স্কুলের বাইরে যাবে, অমনি আরও পাঁচটা ভিন্ন স্তরের, ভিন্ন মানসিকতার ছেলেমেয়ের সঙ্গে মিশতে হবে তাকে, যুঝতেও হবে। তখন কিন্তু তার মনোমত পৃথিবী চলবে না। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে বোঝাপড়া করে তাকে এগোতে হবে, এবং বুঝতে হবে তার পক্ষে কোনটা উপযুক্ত। আমিই সর্বেসর্বা বা আমার জন্যই পৃথিবীর সবাই সর্বদা এগিয়ে আসবে— এমনটা না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এই কঠিন, বধির, অন্যায়-সর্বস্ব পৃথিবীটার সঙ্গে সমানে একটা দর কষাকষি করে জীবন চালিয়ে যেতে হবে। তা না হলে ঠুনকো মন, ঠুনকো মর্যাদার মূল্য দেবে না এই কঠিন ঠাঁই। তখন মনে জাগবে আরও নিরাপত্তাহীনতা, আরও কুঁকড়ে যাবে আত্মা, আরও বিপন্ন হয়ে পড়বে রোজকার জীবন। এমন না হয়ে দাঁড়ায় যে, যখন বিকশিত হওয়ার সময় হল, তখন এই মেয়েরা আরও আরও গুটিয়ে গেল নিজেদের মধ্যে।
এক দিকে গুটিয়ে গিয়ে নিরাপত্তহীনতায় ভোগা, ভঙ্গুর হয়ে যাওয়া, আবার অন্য দিকে নিজেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করা— এই দুই মানসিকতা আপাত ভাবে পরস্পরবিরোধী মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আসলে এদের মধ্যে একটা সংযোগ আছে। যে নিজেকে ছোট থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে শিখবে, সে তো চাইবে যে, সারা পৃথিবী তাকে মাথায় করে রাখুক। মুশকিল হল, পৃথিবী তাকে সেই গুরুত্ব না-ই দিতে পারে। তখন সে মনে মনে ভঙ্গুর হয়ে পড়বে। স্পর্শকাতর হয়ে পড়বে। তার সেই ভঙ্গুর মনটি নির্মম দুনিয়ার কঠিন সংঘর্ষে পড়ে উথালপাথাল হবে। আর সেই ঘষাঘষিতে তার আপন-সর্বস্ব সত্তাটিও নাজেহাল হবে। প্রশ্ন হল, পৃথিবীই বা তাকে কেন গুরুত্ব দেবে না? দেবে না কারণ আর পাঁচ জনও তো আপন-সর্বস্ব হয়েই বড় হচ্ছে। তাই তারাও চাইবে তাদের শর্তে জীবন বাঁচতে। এবং কোথাও না কোথাও গিয়ে অনেকের স্বার্থ ঠোকাঠুকি লাগবে। সেই ঠোকাঠুকিতে কে জিতবে আর কে মানিয়ে নিতে পারবে, কে বুদ্ধিমানের মতো পরিস্থিতি বিচার করে একটা ঠিকঠাক সিদ্ধান্ত নেবে, সেটাই দেখার। এবং সেটা করতে হলে নিজের সত্তায় একটা ভারসাম্যের ধারণা থাকা খুব জরুরি।
এই ভারসাম্যটাই মানসিক স্বাস্থ্যের ভিত। আমাদের বিকৃত উগ্রতা, উগরে-দেওয়া ঘৃণা সেই ভিতে আঘাত করছে। নড়বড়ে ভিতে পোক্ত ইমারত গড়া যায় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy