Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

কলিকাতা একটি ক্লাব

আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করিবার তাহার সময় নাই। সম্ভবত সেই সাহসও নাই। তাই কয়েক সহস্র পূজামণ্ডপ সকল আইন ভাঙিয়া রাস্তা অবরোধ করিয়া গড়িয়া উঠিয়াছে, পুলিশ তাহা দেখিয়াও বাধা দেয় নাই।

শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০৮
Share: Save:

কলিকাতাকে যাঁহারা একটি রাজ্যের রাজধানী বলিয়া মনে করেন, পূজা আসিলে তাঁহাদের ভ্রান্তি দূর হয়। লক্ষ লক্ষ নাগরিকের চিত্তে এই সত্যের উদয় হয় যে, কলিকাতা মহানগর আসলে একটি ক্লাব। মন্ত্রীরা তাহার কর্মকর্তা, কয়েক হাজার পূজা উদ্যোক্তা তাহার সদস্য, পুলিশ তাহার স্বেচ্ছাসেবী। কর্তারা ভিড় সামলাইবার কাজটি বরাদ্দ করিয়াছেন পুলিশের জন্য। পুলিশও স্নানাহার ভুলিয়া ভিড় সামলাইতেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করিবার তাহার সময় নাই। সম্ভবত সেই সাহসও নাই। তাই কয়েক সহস্র পূজামণ্ডপ সকল আইন ভাঙিয়া রাস্তা অবরোধ করিয়া গড়িয়া উঠিয়াছে, পুলিশ তাহা দেখিয়াও বাধা দেয় নাই। কলিকাতাবাসী যাঁহাদের আইন প্রণয়নের ভার দিয়াছে, পুর এলাকায় স্বাচ্ছন্দ্য আনিবার দায়িত্ব দিয়াছে, সেই সাংসদ, বিধায়ক, পুরপ্রতিনিধিরা সকাল-বিকাল পূজার উদ্বোধন করিতেছেন। সেই সকল মণ্ডপে দাঁড়াইয়া, যাহা রাস্তা জুড়িয়া, যানবাহনের গতি অবরুদ্ধ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। যত্রতত্র মণ্ডপ গড়িয়া রাস্তা রুদ্ধ করা হইয়াছে। ফলে রাজপথগুলি কার্যত স্তব্ধ। একের পর এক কর্মদিবসের অনেকগুলি মূল্যবান ঘণ্টার অপব্যয় হইয়াছে গাড়ি নড়িবার অপেক্ষায়। সন্ধ্যার পর বহু গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় গাড়ির প্রবেশ নিষিদ্ধ হইয়াছে। কলিকাতার উপকণ্ঠে বারাসত শহরে কয়েক দিন যানবাহন প্রবেশ নিষিদ্ধ। দুই জাতীয় সড়কের কিছু অংশেও অনুরূপ নিষেধাজ্ঞা। উত্তরবঙ্গমুখী যানকে বহু ঘুরিয়া যাইতে হইবে।

পুরাণ-প্রণেতা লিখিয়াছিলেন, দেবী ভ্রান্তিরূপে সংস্থিতা। একবিংশে আসিয়া এই ভারতীয় মহানগর প্রমাণ করিল, তাহা কেবল ব্যক্তির ভ্রান্তি নহে। আজ গোটা প্রশাসনের নিকট অকর্তব্যকে কর্তব্য মনে হইতেছে। আইনের নির্দেশকে তাচ্ছিল্য রাজধর্ম বলিয়া মনে হইতেছে। গণেশ পূজাতেই স্পষ্ট হইয়াছিল, প্রশাসনের নিকট পূজার সংখ্যা এবং প্রতিমার উচ্চতার বিষয়ে কোনও তথ্য নাই। বিসর্জনের মিছিলে উন্মত্ততা সামলাইতে পুলিশ ব্যর্থ, দুই ব্যক্তির প্রাণ গিয়াছে। শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণের সকল নির্দেশ অমান্য করিয়া ডিজে বক্স বাজিয়াছে বিশ্বকর্মা পূজায়। দুর্গাপূজার পূর্বে তৃতীয় ও চতুর্থীতে যানজট নগরকে রুদ্ধ করিয়াছে। ফের কালীপূজার পূর্বে শহর স্তব্ধ হইল। কলিকাতা যে এ রাজ্যের শিল্প ও বাণিজ্যের রাজধানী, প্রশাসনের শীর্ষকেন্দ্র, চিকিৎসার উচ্চতম স্তরের হাসপাতালগুলি যে এই শহরেই, সেই সকলই বিস্মৃত।

ভ্রান্তি, বস্তুত, লাগামহীন। ইহার প্রতিকারের উপায় নাগরিক সমাজকেই ভাবিতে হইবে। একটি এলাকায় যদি অনুমোদনহীন মণ্ডপ গড়িয়া ওঠে, রাস্তা অবরোধ করিয়া পূজা করা হয়, স্থানীয় পুরপ্রতিনিধি বা বিধায়কও কি তাহার জন্য দায়ী নহেন? মণ্ডপ তো এক দিনে গড়িয়া ওঠে না, পূজাও লুকাইয়া করা সম্ভব নহে। সর্বসমক্ষে যাহারা আইন ভাঙিতেছে, তাহাদের বাধা দিতে অনিচ্ছাও অপরাধ বলিয়াই গণ্য করিতে হইবে। যে পুলিশ অবৈধ পূজা থামাইতে অক্ষম, তাহার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করিতে হইবে। প্রয়োজন হইলে আইন সংশোধন করিয়া প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের দায়বদ্ধতা স্পষ্ট করিতে হইবে। তাঁহাদের দায় স্বীকারে বাধ্য করিবার দায়িত্ব নাগরিকেরই। কাটা সিপাহির ভূমিকাটি আর কত দিন পালন করিবেন কলিকাতাবাসী ?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

কলিকাতা Calcutta Heritage Puja
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE