Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

ঘড়ির কাঁটা, ঘণ্টার ধ্বনি

যন্ত্রে বোতাম টিপতে হবে মন্দের ভাল এমন কারও সমর্থনে। শুধু আশা, যার নামেই টিপি, মনে মনে যেন সেই উপলক্ষে নিজের উপর একটা আস্থা-ভোট দেওয়ার ক্ষমতা রাখি। টমাস হার্ডির একটা মোক্ষম বাক্যবন্ধ আছে, ‘খ্যাপা ঘড়ির তেরোটা বাজা’। ঘড়ি যদি তেরো বার ঢং ঢং করে, আমরা বলব না ওই শেষ ঢংটাই ভুল, আসলে বারোটা বেজেছে; বলব ঘড়িটা একেবারে বিকল, হয় সারাও নয় ফেলে দাও।

সুকান্ত চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

টমাস হার্ডির একটা মোক্ষম বাক্যবন্ধ আছে, ‘খ্যাপা ঘড়ির তেরোটা বাজা’। ঘড়ি যদি তেরো বার ঢং ঢং করে, আমরা বলব না ওই শেষ ঢংটাই ভুল, আসলে বারোটা বেজেছে; বলব ঘড়িটা একেবারে বিকল, হয় সারাও নয় ফেলে দাও।

বঙ্গসমাজের বৈকল্যের লক্ষণগুলি সম্প্রতি বড় বেশি প্রকট হয়ে পড়েছে। আমরা দেখছি, রাজ্যের সর্বময় কর্ত্রী অন্য নানা অপরাধীর পাশাপাশি আদালতে দণ্ডিত ব্যক্তির জনপ্রতিনিধি হওয়ার সমর্থনে প্রকাশ্য সভায় সওয়াল করছেন। দেখছি, প্রথম সারির একাধিক নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির আপাতপ্রবল সাক্ষ্য সত্ত্বেও তাঁরা তা মিথ্যা প্রমাণে তেমন সচেষ্ট হচ্ছেন না, প্রমাণিত না হওয়া অবধি জনজীবন থেকে সরে দাঁড়ানো তো দূরের কথা। আরও বহুগুণ ব্যাপক ও বিপজ্জনক স্তরে দেখছি, ছোট-বড় নির্মাণকার্যে শাসিয়ে-ধমকিয়ে অর্থ আদায় ও নিম্নমানের কাজের দুষ্টচক্র বলতে গেলে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেয়ে গেছে। সত্যি হোক মিথ্যে হোক, সাম্প্রতিক বিশাল দুর্ঘটনার সঙ্গে লোকে স্বভাবতই এর যোগ খুঁজবে; সেই সঙ্গে ভাবতে বসবে, আরও কত মরণফাঁদ রাজ্য জুড়ে এমন ভাবে পাতা আছে। আর অবশ্যই দেখছি বহু পরিষেবা— সবচেয়ে ভীতিকর ভাবে স্বাস্থ্য পরিষেবা— এক সার্বিক অস্থিরতায় ভুগছে; তার সর্বশেষ উদাহরণ, রক্তদানে ইচ্ছুক কয়েকশো মানুষকে ব্লাড ব্যাংকের চৌকাঠ থেকে ভাগিয়ে দেওয়া। তালিকা আরও দীর্ঘ করা যায়— বড় মাপের অপরাধে যুক্ত নয় বা আক্ষরিকভাবে জীবন বিপন্ন হয় না, এমন নজির হিসেবে ধরলে তো কথাই নেই।

এতটা বলার পর অবধারিত প্রশ্ন: এই অনাচারের রাজত্ব কি নতুন? উত্তরটাও অবধারিত: আদৌ নতুন নয়, কয়েক দশক ধরে এই ভয়ংকরী তিলোত্তমা আমরা তিলে-তিলে গড়ে তুলেছি। ভোর চারটেয় দশ বার ঢং ঢং শুনলে মনকে ভুলিয়েছি সব ঠিক হ্যায়, ঘড়িতে দশটা তো বেজেই থাকে। কালক্ষয়ের এই ট্র্যাজেডি যখন পর্যবসিত হচ্ছে প্রহসনে, তেরোটা-চোদ্দোটা বাজতে শুরু করছে, তখনও ভুলে থাকলে কিন্তু বলতে হবে ঘড়িই কেবল খ্যাপা নয়, আমরাও আত্মঘাতী উন্মাদ।

কয়েক দশক ধরে আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক আবহাওয়া উত্তরোত্তর দূষিত হয়ে উঠেছে। আজ যাঁরা ধর্মকথা বলছেন তাঁরাই একদা বাতাসে বিষ ছড়িয়েছেন; অনাচার ঘটিয়েছেন ছক কষে, দক্ষ হাতে স্থান-কাল হিসেব করে, পাকা বিচারে অবস্থা বুঝে, আড়াল রেখে। পোড়খাওয়া অভিজ্ঞ উপদেষ্টার অভাব ছিল না বলে নিপুণ ভাবে অনাচার ঘটাতে যেমন সুবিধা হয়েছে, ন্যূনতম একটা কাণ্ডজ্ঞান সংযমবোধও সে হেতু কাজ করেছে। শুভবুদ্ধির জন্যও ততটা নয়, নিছক অভ্যাস বা সংস্কারবশত কিছু বিধিনিয়ম কিছু কাঠামো বজায় থেকে গেছে। ফলে সমাজের সরব অংশ এমন বন্দোবস্তে মানে-মানে সায় দিতে পেরেছে, চোখ ঠারিয়ে সহাবস্থান করেছে, এমনকী উপকৃতও হয়েছে, যেমন নিঃসন্দেহে হয়েছে সমাজের আরও বেশ কিছু অংশ।

বলা বাহুল্য, এমন বিধানে সদিচ্ছা বা দক্ষতার সঙ্গে মিশেল ছিল স্পষ্ট তঞ্চকতার। জ্ঞানপাপীর ভণ্ডামি হয়তো বেশি করেই পাপ, তবু তার মধ্যে নীতি ও বিধির একটা প্রচ্ছন্ন স্বীকৃতি থাকে, থাকে কূটবুদ্ধির নিয়ন্ত্রণ, অপকর্মের জন্য একটু আড়াল-আব্রুর ব্যবস্থা। আজ আমরা এতটাই হতভাগা যে সেই কপট আব্রুটুকুরও কাঙাল হয়ে পড়েছি। পথেঘাটে খুচরো অনাচারের হরির লুট যাচ্ছে, রাজ্যবাসীকে— বিশেষত যুবসমাজকে, উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে সেই তেতো বাতাসা কুড়িয়ে পেট ভরাতে। এর সবচেয়ে ইঙ্গিতবাহী ফল, যেটুকু ভাল কাজ হচ্ছে (কিছু অবশ্যই হচ্ছে) তা-ও যেন হচ্ছে হুজুগের বশে, অগ্রপশ্চাৎ অগ্রাহ্য করে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে, বিশেষত উন্নত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসাকেন্দ্রের ক্ষেত্রে, যে আকাশচুম্বী প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে, তার ভগ্নাংশেরও রূপায়ণ নিয়ে গভীর সন্দেহ তাই ঘোচার নয়। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বলতেই হয়, খাতাকলমে দেদার নতুন প্রতিষ্ঠানের পত্তন হলেও পাঁচ বছর আগে বহু বিপর্যয় সামলে যথার্থ উন্নতির যে সম্ভাবনা ছিল, রূপায়িতও হচ্ছিল একটু-একটু করে, আজ তা বহুলাংশে ক্ষীণ; আরও পাঁচ বছর এই পথে চললে সমূলে বিনষ্ট হবে।

পাঠককে দোহাই, দুই রাজনৈতিক পর্যায়ের তুলনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়, যদিও তুলনাটা অবধারিত ভাবে এসে পড়ছে। বরং আমি করতে চাই সাধারণ নাগরিকদের তরফে একটু আত্মসমীক্ষা। আমাদের সুখস্বাচ্ছন্দ্য, সামাজিক এমনকী ব্যক্তিগত জীবন, একটা স্তরের নীচে রুটি-রোজগার পর্যন্ত আমরা নির্দিষ্ট কয়েকটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর হাতে সঁপে দিয়েছি, তারাই পালা করে ভাগ-বাটোয়ারায় আমাদের ভবিতব্যের দখল উপভোগ করছে। বাঙালির বড় সাধের তাত্ত্বিক সমাজচেতনা আমাদের ঠেলে দিয়েছে অন্ধগলিতে সর্বনাশের পথে: তত্ত্ব কবে দূর হয়েছে, চেতনাও অন্তর্হিত, সমাজটারই নাভিশ্বাসের জোগাড়। দলীয় রাজনীতির বাইরে প্রভাবশালী সামাজিক শুভশক্তি বাংলায় বরাবরই কম। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় আমরা কর্তাভজার দল, এই অসম্ভব আশায় দিন কাটাই যে আমাদের উদ্ধার করবেন স্বর্গলব্ধ কতিপয় মহাপুরুষ, আমরা কাগজে-টিভিতে তাঁদের কীর্তি দেখে মর্জিমত বাহবা দেব বা নিন্দামন্দ করব। একক বা সমবেত ভাবে নাগরিক অধিকার প্রয়োগে আমাদের রুচি নেই।

এই বিশ্লেষণ আগামী এক মাসে ভুল প্রমাণিত হলে আমাদেরই মঙ্গল। সমস্যাটা কিন্তু ঠিক করে বোঝা দরকার। আট-দশ বছর আগে, তৎকালীন সরকারের কিছু চাঞ্চল্যকর অপকীর্তির বিরুদ্ধে একটা সাধারণ সামাজিক চেতনা সত্যিই জেগে উঠেছিল। প্রায় নজিরবিহীন ভাবে কিছু বিশিষ্ট ও অসংখ্য সাধারণ মানুষ মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে একটা সরব অবস্থান নিয়েছিলেন। কিন্তু অচিরে দেখা গেল, সেই প্রতিরোধের স্রোত মোড় ঘুরে বইতে লাগল নিছক একটা বিরোধী রাজনীতির খাতে। কেউ কেউ সেই স্রোতে গা ভাসালেন, অধিকাংশই হয়ে পড়লেন বিচ্ছিন্ন ও বিভ্রান্ত। আজ যাঁরা ওই দ্বিতীয় দলের প্রতি বীতশ্রদ্ধ, তাঁরা প্রায়ই আশ্রয় খুঁজছেন অন্য কোনও দলের বা গোষ্ঠীর ছত্রছায়ায়। কিছু ব্যক্তি যে দলীয় শিবিরের বাইরে স্বতন্ত্র অবস্থান
থেকে নাগরিক মূল্যবোধের অঙ্গারটুকু আগলাচ্ছেন, তাঁদের মনে হয় সাধুবাদের অতিরিক্ত কিছু প্রাপ্য। যদি স্বভাবসিদ্ধ সিনিসিজ্মবশত মনে করি তাঁদের অন্য কোনও স্বার্থ আছে, তবুও
প্রাপ্য, কারণ তাঁদের জন্যই আগুনটা একেবারে নিভে যায়নি ।

বাঁকুড়ার এক অনামী গ্রামবাসী সে দিন বলেছেন, তাঁরা হলেন রাজনীতির ফুটবল, পেশিবিশিষ্টেরা যে দিকে পদাঘাত করবেন সে দিকেই গড়াতে বাধ্য। স্বাধীনতার ঊনসত্তর বছর বাদে এক নাগরিকের এই উক্তি শুনে রাজনীতিকরা অবশ্যই উৎফুল্ল হবেন, আমরা বাকিরা লজ্জা রাখব কোথায়, ভীতিই বা জয় করব কী করে? সল্টলেক-বালিগঞ্জের অভিজাত বাসিন্দাদের এমন ভাবে কথাটা কবুল করতে সম্মানে বাধবে; সেই সম্মানবোধটাই কিন্তু তাঁদের অসহায়তা বাড়িয়ে দিচ্ছে, অন্য সব বাধার সঙ্গে যুক্ত করছে মর্যাদা রক্ষার বাড়তি দায়; আবার অন্য দিকে তাঁদের মন দুর্বল করছে এই ভরসা, যে ভোটদানের সঙ্গে তাঁদের বাঁচার তাগিদ, রোজগারের তাগিদ যুক্ত নেই, যার জেরে সত্যিকারের সম্বলহীন মানুষ শেষ অবধি রুখে দাঁড়ায়। শহরের শিক্ষিত অভিজাত পল্লিগুলোই অতএব বিশেষ করে নির্বাচনের দিন হিংসা-হুমকি-সন্ত্রাসের ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে। এই হেঁয়ালিটা নির্বাচন-কর্তারা চট করে না বুঝলেও বঙ্গবাসীর কাছে সহজবোধ্য হওয়া উচিত। সেখানকার বিশিষ্ট অবসরপ্রাপ্ত বাসিন্দারা উচ্চপদের বর্ম হারালে প্রকৃতই অসহায়; সাধারণ নাগরিক হিসাবে প্রতিষ্ঠা অর্জনের চেষ্টা তাঁরা কদাচ করেননি, হয়তো বা স্বপদে অধিষ্ঠিত থাকতে অপরের নাগরিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করেছেন। তাঁদের বর্তমান উত্তরসূরিদের কথা বলা নিষ্প্রয়োজন। সম্মাননীয় ব্যতিক্রম অবশ্যই কিছু আছেন, কিন্তু পুলিশ-আমলা থেকে সরকারি চিকিৎসক— পেশাগত আত্মমর্যাদার এমন সার্বিক অবলুপ্তি হয়তো এক দশক আগেও অচিন্তনীয় ছিল। সেটা এক বার লোপ পেলে, নিজের কাছে নিজের কোনও মূল্য না থাকলে, অন্যের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিতে অবশ্যই আর বাধা থাকে না।

নির্বাচন আমাদের দরজায় কেবল কড়া নাড়ছে না, পাড়ার বাহিনীর মতো, ঝটিকা পুলিশের মতো রীতিমত পদাঘাত করছে। এক দল হানাদারের নানা সুরে ও ভাষায় অভিন্ন বার্তা, আমাদের ভোট না দিয়ে যাবে কোথায়? আর এক দলের অনভ্যস্ত উদার উচ্চারণ, যাকে খুশি ভোট দাও, নিজের খুশি মতো দিও কেবল। যন্ত্রে বোতাম টিপতে হবে এঁদেরই কারও সমর্থনে। আদৌ না টেপাটা কোনও সমাধান নয়, কারণ তাতে আমার সবচেয়ে অবাঞ্ছিত প্রার্থীরই লাভ সবচেয়ে বেশি। এটুকু শুধু আশা, যার নামেই টিপি, মনে মনে যেন সেই উপলক্ষে নিজের উপর একটা আস্থা-ভোট দেওয়ার ক্ষমতা রাখি। নইলে কিন্তু সমাজের সেই বিকল ঘড়িটা বাজতেই থাকবে— বিশ বার, পঁচিশ বার, পঞ্চাশ বার। আর আমাদের দশা হবে সেই দুঃস্বপ্নের মতো, যেখানে শুনতে থাকি শিয়রে একটা পাগলাঘণ্টি বেজে চলেছে, কিছুতেই সেটা বন্ধ করতে পারছি না।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে এমেরিটাস অধ্যাপক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Assembly Election 2016
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE