Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

প্রহেলিকা

কলিঙ্গ-উৎকল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনায় মৃত ২২ জন সেই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন। সুরেশ প্রভু ইহাকে ধাঁধা ভাবিতেই পারেন। দ্বিতীয় ইউপিএ জমানায় রেলে নিরাপত্তাখাতে বাৎসরিক যত টাকা বরাদ্দ হইত, এনডিএ-র শাসনকালের তিন বৎসরে তাহার পরিমাণ দেড়গুণেরও বেশি বাড়িয়াছে। নিরাপত্তা তহবিল তৈরি হইয়াছে।

শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

চাঁদ সদাগর তাঁহার পুত্রের জন্য লৌহবাসর বানাইয়া দিয়াছিলেন। সুরেশ প্রভু চাঁদ সদাগর নহেন, ভারতীয় রেলের যাত্রীদেরও তিনি লখিন্দর জ্ঞান করেন বলিয়া শোনা যায় নাই। তবুও, তাঁহার আমলে যে রেলের নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে খরচ বাড়িয়াছে— লৌহবাসর না হউক, নিরাপত্তাবিধানের কিছু চেষ্টা হইয়াছে— তাহা অস্বীকার করা যায় না। তবু, ছিদ্র থাকিয়া গিয়াছে। বিপুল ছিদ্র। সেই ফাঁক গলিয়া গত তিন বৎসরে ভারতীয় রেলে দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়াইয়াছে ৬৫২। কলিঙ্গ-উৎকল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনায় মৃত ২২ জন সেই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন। সুরেশ প্রভু ইহাকে ধাঁধা ভাবিতেই পারেন। দ্বিতীয় ইউপিএ জমানায় রেলে নিরাপত্তাখাতে বাৎসরিক যত টাকা বরাদ্দ হইত, এনডিএ-র শাসনকালের তিন বৎসরে তাহার পরিমাণ দেড়গুণেরও বেশি বাড়িয়াছে। নিরাপত্তা তহবিল তৈরি হইয়াছে। রেলের মূলধনী খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির বিষয়েও প্রভু বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করিয়াছেন। তবুও এই মৃত্যুর মিছিল কেন? এই প্রশ্নের উত্তরও পরিসংখ্যানে আছে। গত পাঁচ বৎসরে ভারতীয় রেলে যত দুর্ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহার সিংহভাগ— ৫৩ শতাংশ— ঘটিয়াছে ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ায়। এবং, মোট দুর্ঘটনার ৮৫ শতাংশই ঘটিয়াছে কোনও মানুষের ভুলে। অর্থাৎ, নিরাপত্তাখাতে বরাদ্দবৃদ্ধি, উন্নততর প্রযুক্তি আমদানি ইত্যাদির পাশাপাশি একেবারে গোড়ায় গলদ থাকিয়া গিয়াছে। কলিঙ্গ-উৎকল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনাটি সেই গলদের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

দুর্ঘটনার পর একটি অডিয়ো টেপ প্রকাশিত হইয়াছে। আনন্দবাজার পত্রিকার তরফে সেই টেপটির সত্যতা যাচাই করা হয় নাই। কিন্তু, তাহার কথোপকথনটিকে যদি ‘সত্য’ হিসাবে ধরিয়া লওয়া হয়, তবে এক মারাত্মক ছবি ফুটিয়া উঠে: রেললাইনে ফাটল মেরামতির জন্য কুড়ি মিনিট লাইন বন্ধ রাখিবার অনুরোধ করিতেছেন স্থানীয় আধিকারিক, এবং তাহার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জানাইয়া দিতেছেন, যেহেতু সেই মুহূর্তে অনেকগুলি গাড়ি যাতায়াত করিবে, ফলে লাইন বন্ধ রাখা সম্ভব নহে। এবং, সংবাদে প্রকাশ, যে ফাটলটি মেরামতের কথা হইতেছিল, তাহা প্রায় দুই মাস পুরাতন। অনুমান করা চলে, গোটা দেশে এমন অসংখ্য রেললাইন আছে, ফাটলকে অবজ্ঞা করিয়াই যাহার উপর ট্রেন চলিতেছে। বস্তুত, খারাপ লাইনের উপর ধীরে ট্রেন চালানো এখন ভারতীয় রেলের প্রতিষ্ঠিত অভ্যাস। কতখানি ঝুঁকি লইয়া ট্রেনগুলি চলিতেছে, দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানই তাহার প্রমাণ। এক্ষণে উল্লেখ্য, প্রভুর আমলে রক্ষীহীন লেভেল ক্রসিং-এর সংখ্যা বিপুল ভাবে হ্রাস পাইয়াছে। পূর্বে এই লেভেল ক্রসিংগুলি দুর্ঘটনার মূল কারণ ছিল। সেই কারণটি সরিয়া যাওয়ার পরও এত মৃত্যু বলিতেছে, সমস্যা গভীর।

অভিজ্ঞ জনেদের মতে, ভারতে রেললাইনগুলির পক্ষে এত ট্রেন ধারণ করা অসম্ভব। গত পনেরো বৎসরে যাত্রিবাহী ট্রেনের সংখ্যা বাড়িয়াছে ৫৬ শতাংশ, মালগাড়ি ৫৯ শতাংশ। কিন্তু, রেললাইন বাড়িয়াছে মাত্র ১২ শতাংশ। অর্থাৎ, চাপ বাড়িয়াই চলিতেছে। পথটি বিপর্যয়ের, কিন্তু রাজনীতি এই পথেই হাঁটে। যাঁহারা রেল চলাচলের দায়িত্বে আছেন, তাঁহারাও জোড়াতালি দিয়া দায় সারিতেছেন। নচেৎ, দুই মাস ধরিয়া একটি ফাটল থাকে কী উপায়ে? রেলের নিরাপত্তাখাতে ব্যয়বরাদ্দ বাড়াইয়া এই ত্রুটিগুলি ঢাকিবার কোনও উপায় নাই। মানুষের ভুলে দুর্ঘটনা ঘটিয়াই চলিয়াছে, কারণ ভুলের যথেষ্ট শাস্তি হয় না। এই দায়গুলি লইতে হইবে। প্রধানমন্ত্রী এক দিকে বুলেট ট্রেনের খোয়াব ফিরি করিবেন, আর অন্য দিকে প্রাণহানি অব্যাহত থাকিবে, এই দ্বিত্ব চলিতে পারে না। নির্বাচন সত্য, তাহার প্রচারের জন্য উদ্বেগ আরও সত্য, কিন্তু যাঁহাদের নিকট বুলেট ট্রেনের গল্প বেচিবেন, তাঁহাদের প্রাণরক্ষার দায়িত্বটি আগে সামলানো উচিত নহে কি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE