Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

টাকা আছে, তবু শ্রমিক বঞ্চিত

ভারতের জিডিপি-র প্রায় এক-পঞ্চমাংশ আসে নির্মাণ শিল্প থেকে। যার বেশির ভাগ শ্রমিকই অসংগঠিত। এঁদের কল্যাণের জন্য আইন (১৯৯৬) অনুসারে তৈরি হয়েছে ‘নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদ।’ নির্মাণ কাজগুলির দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্মাণ সংস্থা থেকে আদায়-করা টাকা (সেস) থেকে শ্রমিকদের চিকিৎসা, দুর্ঘটনা বা মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ, পেনশন, ইত্যাদি পাবেন।

সৌমেন রায়
শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০১৭ ০৬:০০
Share: Save:

যাঁদের শ্রমে তৈরি হচ্ছে বড় বড় আবাসন, ফ্লাইওভার, শপিং মল, সেই নির্মাণ শ্রমিকেরা কেমন আছেন? মাঝে মাঝেই তাঁদের কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় জখম হওয়ার খবর পাওয়া যায়, এমনকী মৃত্যুরও। তখন হয়তো তাঁদের নিরাপত্তার অব্যবস্থা নিয়ে একটু-আধটু আলোচনা হয়। কিন্তু বাস্তব অবস্থা পালটায় না। সামগ্রিক ভাবেই, নির্মাণ শ্রমিকদের সুযোগসুবিধে বা নিরাপত্তার আয়োজন নিতান্তই অপটু। অথচ ঘটনা হল, তাঁদের জন্য যে টাকা বরাদ্দ আছে, এমনকী জমা আছে, তা-ও খরচ হয় না। শ্রম বিষয়ক সংসদীয় কমিটির রিপোর্ট বলছে, নির্মাণ শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য গত কুড়ি বছরে ৩২ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি সেস জমা পড়েছে, খরচ হয়েছে মাত্র সাড়ে সাত লক্ষ কোটি টাকা। অবহেলা এতটাই তীব্র।

ভারতের জিডিপি-র প্রায় এক-পঞ্চমাংশ আসে নির্মাণ শিল্প থেকে। যার বেশির ভাগ শ্রমিকই অসংগঠিত। এঁদের কল্যাণের জন্য আইন (১৯৯৬) অনুসারে তৈরি হয়েছে ‘নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদ।’ নির্মাণ কাজগুলির দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্মাণ সংস্থা থেকে আদায়-করা টাকা (সেস) থেকে শ্রমিকদের চিকিৎসা, দুর্ঘটনা বা মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ, পেনশন, ইত্যাদি পাবেন। কিন্তু সমস্যা প্রধানত তিনটি। এক, অধিকাংশ শ্রমিকের নথিভুক্তি হয়নি। দুই, ব্যাপক হারে সেস ফাঁকি দিচ্ছে নির্মাণ সংস্থাগুলো। তিন, সেস-এর বড় অংশ খরচ হচ্ছে না।

সরকারি হিসেব, সাড়ে চার কোটি নথিভুক্ত নির্মাণকর্মীর আড়াই কোটি কর্মী সেস-এর টাকার সুবিধে পেয়েছেন। কিন্তু শ্রমিক সংগঠনগুলির আন্দাজ, ভারতে নির্মাণ শ্রমিকের সংখ্যা বারো কোটি (একশো দিনের কাজের প্রকল্পে নির্মাণ শ্রমিকদের বাদ দিয়ে)। মানে তিন জনে দু’জনই বাদ পড়েছেন। এঁদের মধ্যে আছেন সেই মজুররা, যাঁরা কোনও ঠিকাদারের অধীনে কাজ করেন। দেড় হাজার-দু’হাজার শ্রমিক লাগিয়ে যে নির্মাণ হচ্ছে, সেখানে খাতায়-কলমে দেখানো হয় ৫০-৬০ জন। তার কারণ, ঠিকাদারেরা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি দিতে চান না। উল্টে ‘মেট’ ধরনের শ্রমিক জোগানদাররা কাজ দেওয়ার জন্য কমিশন আদায় করেন। এ ছাড়াও শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য বিধিনির্দিষ্ট সুযোগসুবিধে দিতে নারাজ ঠিকাদারেরা। নির্মাণকর্মীর সংখ্যা কমিয়ে দেখাতে আগ্রহী তাঁরা।

যাঁরা পরিযায়ী শ্রমিক, তাঁদের সুরক্ষার জন্য সরকারের বিশেষ আইন রয়েছে। তাঁদের থাকার জায়গা, বিশ্রামের জন্য বরাদ্দ সময়, দুর্ঘটনা বা মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা। সেগুলো দিতে চান না বলে অধিকাংশ ঠিকাদারেরা মজুরদের ‘পরিযায়ী’ বলে দেখান না। ভিন্‌রাজ্যে পুলিশে ধরলে, মৃত্যু হলে ঠিকাদার সহজেই দায় এড়ান। দিল্লি, রাজস্থান, গুজরাত, মহারাষ্ট্র, কেরলে নির্মাণ শ্রমিকরা আসেন পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড থেকে। এঁদের সুরক্ষা নেই বলেই চলে।

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী শ্রমিক ইউনিয়নগুলি ২০০৭-০৮ সাল থেকে শ্রমিকদের নামের নথিভুক্তি শুরু করে। কিন্তু পূর্ণ সময়ের শ্রমিক ছাড়া, ক্যাজুয়াল বা পরিযায়ীদের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়নি। তৃণমূল সরকার ২০১২-১৩ সালে এ বিষয়ে উদ্যোগী হয়। শ্রমিক সংগঠনগুলির হিসেবে এ রাজ্যে অন্তত ৩২ লক্ষ নির্মাণ শ্রমিক আছেন। সরকারি তথ্য, আটাশ লক্ষের নথিভুক্তি হয়েছে। হিসেবে যদি জল না থাকে, তা অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য। তা সত্ত্বেও সমস্যা এই যে, প্রতি বছর ‘রিনিউ’ না হলে শ্রমিক সহায়তা পাবেন না। শ্রমিক বা তাঁর পক্ষ নিয়ে শ্রমিক ইউনিয়ন বার্ষিক তিরিশ টাকা দিয়ে নাম নবীকরণ করবেন, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু সে কাজটা ঠিক মতো হয় না। ফলে শ্রমিক দুর্ঘটনায় মৃত বা আহত হলে, বা চিকিৎসার জন্য খরচ চাইলে, শ্রমকল্যাণ প্রকল্পের টাকা মেলে না। কত শ্রমিকের নাম ‘রিনিউ’ হয়ে আছে, সেই তথ্য কোনও সরকারি সূত্র থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

পশ্চিমবঙ্গে নির্মাণ ব্যবসায় কত বৃদ্ধি হয়েছে, তার একটা আন্দাজ মেলে সেস আদায়ে বৃদ্ধি থেকে। ২০১৪ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত জমা পড়েছিল মোট ২৯০ কোটি টাকা। পরবর্তী দুই আর্থিক বছরের শেষে মোট জমা ১১৪৯ কোটি টাকা। কিন্তু এটাও সেস-এর ঠিক পরিমাণ নয়। সরকারি নির্মাণের বরাত-পাওয়া সংস্থা এবং ব়ড় কর্পোরেট নির্মাণ সংস্থা ছাড়া আর প্রায় কোনও নির্মাতা সেস দেন না। আদায়কারী সংস্থার কর্মীদের ‘ম্যানেজ’ করে তাঁরা সেস ফাঁকি দেন। যদি সকলে সেস দিতেন, তা হলে আদায় অন্তত তিনগুণ হত।

সেস খরচের বিষয়ে ভারতের গড় খরচ যেখানে তহবিলের সিকি ভাগ, রাজ্যে সেখানে খরচ হয়েছে অর্ধেক (গত কুড়ি বছরে আদায় ১১৪৯ কোটি টাকা, খরচ ৫৩১ কোটি টাকা)। কিন্তু যে শ্রমিকেরা টাকা থাকতেও প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত, তাঁদের কাছে এটা কোনও সান্ত্বনা নয়।

টাকা খরচে ব্যর্থ হয়ে এখন কেন্দ্র প্রস্তাব দিচ্ছে, শ্রমিকদের বিভিন্ন ওয়েলফেয়ার বোর্ড (নির্মাণ, পরিবহণ, বিড়ি, গ্রামীণ হস্তশিল্প, প্রভৃতি) একত্র করা হবে, প্রতিটির খাতে পাওয়া সেসও একত্র করে একটিই তহবিল তৈরি করা হবে। শ্রমিকদের কোনও কোনও সংগঠন এটাকে সমর্থন করছেন। প্রশ্ন হল, নির্মাণ শ্রমিক বা বিড়ি শ্রমিকের কাছে সুবিধে পৌঁছনোর ব্যবস্থা না হয়ে থাকলে, সকলের জন্য জানলা খুলে দিলে কী হবে? যে দফতর বেশি তৎপর, তার অধীনে থাকা শ্রমিকরা বেশি টাকা পাবেন। বিড়ি মালিকদের থেকে পাওয়া সেস পরিবহণ কর্মীদের কল্যাণে গেলে বিড়ি কর্মীদের কী উপকার হবে? বেশি খরচ দেখাতে পারলে সরকারের মুখ বাঁচবে, শ্রমিকের প্রাণ বাঁচবে না।

ন্যাশনাল সেন্টার ফর লেবার-এর সঙ্গে যুক্ত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Labour CESS GDP Indian Economy সেস
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE