Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

ধক আছে, ছক নাই

সত্যি বলব, গা ম্যাজম্যাজ করছিল। অ্যাদ্দিন ধরে দেশের মাথায় বিরাজ করছি, ইতনা লম্বা-চওড়া কথা বলে ক্ষমতায় এসেছি, কিন্তু ইতিহাসে থেকে যাওয়ার মতো করলামটা কী?

শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

সত্যি বলব, গা ম্যাজম্যাজ করছিল। অ্যাদ্দিন ধরে দেশের মাথায় বিরাজ করছি, ইতনা লম্বা-চওড়া কথা বলে ক্ষমতায় এসেছি, কিন্তু ইতিহাসে থেকে যাওয়ার মতো করলামটা কী? রাজপথে ভুজঙ্গাসন ডিসপ্লে দিলাম, ভাবলাম দিগ্‌দিগন্ত থেকে ইয়োগা দেখাবার ডাক আসবে, কার্নেগি হল-এ হলাসন, আইফেল টাওয়ারে শীর্ষাসন, ও বাবা, লোকে মহান ভারতীয় ঐতিহ্যবিক্কিরিকে আমলই দিলে না। ক’দিন ভাবলাম, পাকিস্তানকে অ্যাটাক করি। কিন্তু পাকিস্তান তো দুবলা-পাতলা বাচ্চা নয়, ছেড়ে কথা বলবে না, তার চেয়ে বড়: আজকের দুনিয়ায় যুদ্ধ বাধালে আন্তর্জাতিক ময়দানে মুখ দেখানো না-মুমকিন। তার ওপর ওর পাশে চিন আছে, ধুয়ে দেবে। ফেসবুকের লোকেরা তো যুদ্ধে যাবে না! তা হলে উপায়? ভাবতে ভাবতেই বুদ্ধির একটা চকিত চড়াক। কমিক্‌সের হিরোদের যেমন মোক্ষম লগ্নে বাল্‌ব। আমি নিজেকে চাপে ফেলছি কেন? টেনশন তো লেনে কা নেহি, দেনে কা হ্যায়। যারা আমাকে মাথায় তুলে নাচছে না, সেই আবোদা দেশের প্রত্যেকে যদি টোটাল আছোলা বাঁশ খেয়ে যায়? আসমুদ্রহিমাচল ১৩৫ কোটি লোক যদি ত্রাহি ত্রাহি রবে পাঁইপাঁই দৌড়য়, আর আমি স্টেডিয়ামে বসে মজা দেখি ও পপকর্ন চিবুই? যদি ভারতের কোত্থাও আর কোনও কথা না থাকে, একটাই টপিক বনবনায়, কোহালি আটশো রান করলেও কারও কিচ্ছু না এসে যায়, লোকে শুধু আড্ডায় স্বপ্নে মোনোলগে একটাই ব্যাপার নিয়ে হয়রান হয়? চ্যালারা বললে, স্যর, মানুষ তো দিনমান শুধু টাকা নিয়ে ভাবে, টাকার জগতে একটা সর্বনাশ এনে দিন। সব্বার জীবন তছনছিয়ে যাবে, আমরা সেটা বিপ্লব বলে চালাব। বহু ক্ষণ ঠুকুরঠুকুরের পর এই নইলে ছয়ছক্কা?

মুশকিল হল, তাড়ু প্লেয়ার প্রকাণ্ড হাততালি পায় বটে, কিন্তু এক্সপার্টরা তার ব্যাট-প্যাডের ফাঁক দিয়ে ফাঁকিবাজিটা নজর করে ফেলে। বুঝিয়ে দেয়, কাণ্ডজ্ঞান নেই বলেই এর সাহস আছে। অমর্ত্য সেন বা কৌশিক বসু, আরও এন্ডিগেন্ডি যেমন বলছে। কিসু এসে যায় না অবশ্য, কারণ পাবলিক ওদের কথা এক বর্ণও বোঝে না। এ দেশের পাবলিক বোঝে শুধু যাত্রাপালা। এই জন্যেই তো জাপান থেকে এসে একটা সভায় ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কেঁদে নিলাম। আরে ভাই, কিচ্ছুই পারি না যখন, অ্যাক্টিংটা তো উঁচু লেভেলে রাখতে হবে। তা, আমার মুখ্যু দেশবাসী কিন্তু আমার আশা পূরণ করেছে। তারা ভেবেছে, লোকটা কষ্ট যখন দিচ্ছে, কেষ্ট তখন মেলাবে, শিয়োর। হাহা, দেশটাকে যত দেখি, হাসি চেপে রাখা দায় হয়। এরা সাফারিং-কে এমন গৌরবে চান করিয়েছে, হাঁপানি রোগীকে অবধি মহত্ত্বের ট্রফি দেয়। এটিএম-এর বিশাল লাইনে দাঁড়িয়ে, না-খেয়েদেয়ে, রোদে ফিট হয়ে পড়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমাকে অভিসম্পাত দূরস্থান, বলছে, ওঃ, লোকটার ধক আছে! এক বারও মাথায় ঢুকছে না, ধক আছে, কিন্তু ছক নেই।

আসলে আমি পাল্‌স-টা বুঝে গেছি। এই লোকগুলো চায় সত্তর-আশির হিন্দি সিনেমা। সেখানে লাস্ট সিনে বড়লোক মার খেত, গরিব জিতত। আমি এমন একটা ভান করলাম, বড়লোকদের সর্বনাশ করছি। ব্যস, মেজরিটির সেডিজ্‌ম উসকে উথলে উরিব্বাস। তারা ভাবল, আমার নিজের নাক কাটছে কাটুক, পাশের বাড়ির ওই নাক-উঁচু বড়লোকটার সর্বনাশ হচ্ছে তো! বহুত আচ্ছা! লাগাও নাগরদোলা! আমি চাকরকে মাইনে দিতে পারছি না? আমার দোকানে মাছি তাড়াতে হচ্ছে? আমার শস্য ঘরে তুলতে পারছি না? আমার মেয়ের বিয়ে দিতে হচ্ছে অতিথিদের নুন লেবু খাইয়ে? আলু-পটলের বাজার আমার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে? দৈনন্দিন বাঁচাটাই নরক হয়ে যাচ্ছে? কুছ পরোয়া নেহি। আসল কথা হল অমুক ডাক্তার নাকি ছাদে পাঁচশো টাকার নোট পুড়িয়েছে? তমুক উকিল নাকি গলায় দড়ি দিতে গেছিল কিন্তু ক্যাশ নেই বলে ভাল দড়ি কিনতে পারেনি, ঠাস করে পড়ে গেছে?

আমি যে হুড়ুদ্দুম একটা সিদ্ধান্ত আছড়ে দিয়েছি, কিন্তু সেটা কী ভাবে বাস্তবে রূপায়িত করতে হবে তার ন্যূনতম জ্ঞান আমার নেই, প্রথমে পঞ্চাশ দিন সময় চেয়েছিলাম সব ঠিকঠাক করে দেওয়ার জন্যে কিন্তু এখন আমার অর্থমন্ত্রী আঙুল ফাঁক করে বলেছেন আর এট্টু সময় লাগবে, এ-ই ন’মাস, পুরো ব্যাপারটাই নাট্যক্যাংলা জনপিণ্ডি ওভারলুক করে যাচ্ছে। এটাই আমার রিডিং ছিল। বাজারে নগদ টাকা কমে গেলে তাতে ক্ষতি কোথায়, এই দেশের লাখ কোটি মানুষ কাজ করে ক্যাশের ভরসায়, দিন আনে দিন খায়, পেটিএম-এ দিচ্ছি বললে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে— তাদের কী হবে, ব্যবসাগুলো কমে এলে হুহু করে নিচুতলার ছাঁটাই শুরু হয়ে যাবে, তার মধ্যে সে নিজেও থাকতে পারে, এ সব নিয়ে আদ্ধেক লোকের মাথাব্যথা নেই। তারা বাঁচছে ক্লাইম্যাক্সের জোশে। শাহরুখের ফিল্মে তাদের কিছু এসে যায় না, কারণ তারা আশেপাশে তাকিয়ে নিজেদের সুপারহিট ইস্টম্যানকালার দেখতে চাইছে। সে সিনারিতে এক দিন ধনকুবেরদের মার্সিডিজে কাক র‌্যানডম ইয়ে করবে। আর ভারতের জাতীয় খেলা হয়ে যাবে ‘এটিএম-এটিএম’।

এক বার ভাবছি দু’হাজারের নোটটা তুলে দেব। এক বার ভাবছি সোনা রাখার ব্যাপারে একটা ব্যান লাগাই, যাতে লকার-রুমে হাহাকারটা ছড়িয়ে দেওয়া যায়। বেশ একটা নেশা ধরে গেছে। ট্রায়াল-এরর পদ্ধতিতে অমরত্বের দিকে যাচ্ছি, গোটা দেশময় আমার গিনিপিগেরা কিলবিল, আজ ল্যাবে গিয়ে এটাকে সেঁকো বিষ দিই, কাল ওটাকে শিকে বিঁধে রাখি। অন্য মস্তানেরা তো অ্যাত্ত ফড়ফড়ায়, এমন একখান সুইপিং স্ম্যাশ কেউ দেখাতে পেরেছে, যা থেকে ক্রমাগত বেরচ্ছে নির্বুদ্ধিতা, গোঁয়ার্তুমি, সস্তা জনপ্রিয়তা-লোভের চিড়িকচাঁই লাইটিং, সঙ্গে নিষ্ঠুরতার ধোঁ? হাঃ, সব নেতা তোদের বক দেখায়, আমি ধক দেখালাম!

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE