নীতি আয়োগের সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলিতেছে, দেশের একুশটির মধ্যে সতেরোটি বড় প্রদেশে কন্যা-জন্মের হার কমিয়াছে। গুজরাতে কমিয়াছে এক ধাক্কায় ৫৩ পয়েন্ট, চোখ কপালে তুলিবার পক্ষে যে সংবাদ যথেষ্ট। তাহার নীচে হরিয়ানা (৩৫ পয়েন্ট), রাজস্থান (৩২ পয়েন্ট), উত্তরাখণ্ড (২৭ পয়েন্ট), মহারাষ্ট্র (১৮ পয়েন্ট), হিমাচলপ্রদেশ (১৪ পয়েন্ট), ছত্তীসগঢ় (১২ পয়েন্ট)। এ-দিকে দেশের গুজরাত-তিলক প্রধানমন্ত্রীর ‘বেটি বচাও বেটি পঢ়াও’ নামক কার্যক্রম লইয়া কিন্তু প্রশংসার অন্ত নাই। আত্মপ্রচারের রমরমার মধ্যে সংখ্যাতত্ত্বের এই বাস্তব ছবিটি কোনও স্থান বা স্বীকৃতি পাইল না। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল পর্যন্ত স্বীকৃত গণ্ডির বাহিরে গিয়া প্রধানমন্ত্রীর কন্যাশিশু প্রকল্পের বিস্তর গুণ গাহিয়া রাজ্যের কন্যাশ্রী প্রকল্পের সমালোচনা করিলেন। বেটি বচাও কত ‘বড়’ এবং কত ‘কার্যকর’, ব্যাখ্যা করিলেন। কন্যাভ্রূণহত্যার নিশ্চিত বাস্তবে পা রাখিয়া, বৈষম্য-লাঞ্ছনা-শারীরিক নিগ্রহের প্রাত্যহিক প্রবাহের সামনে দাঁড়াইয়া এই আত্মবিস্মৃতি ও আত্মপ্রশংসা সত্যই চমকপ্রদ। মোদী সরকারের নানাবিধ শব্দসর্বস্বতার মধ্যেও ইহা একেবারে সামনের সারিতে জায়গা করিয়া লয়।
রাজ্যপালের মন্তব্য হিসাবে একটি কথাই বলিবার। এই ধরনের বিতর্ক কেন্দ্র ও রাজ্যের ক্ষমতা পরিসরের মধ্যে না ডাকিয়া আনাই বাঞ্ছনীয়। কন্যাবৈষম্য এ-দেশের একটি সুগভীর গ্লানির বিষয়। ইহাকে নানা ভাবে মোকাবিলার চেষ্টা করা হউক। বিভিন্ন সরকার বিভিন্ন ভাবে সেই চেষ্টা করুক। কোনও প্রকল্পের দোষগুণ আলোচনা করিলে সুরটি হওয়া উচিত গঠনমূলক। স্পষ্টতই, মাননীয় রাজ্যপাল তাহা করেন নাই, প্রতিযোগিতার আবহেই বড় ছোট বিচার করিতে বসিয়াছেন। কন্যাশ্রী একটি সীমিত উদ্দেশ্যের প্রকল্প, বেটি বচাও অনেক বিস্তৃত উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত। সচেতনতা বাড়ানো একটি দীর্ঘমেয়াদি কাজ, সেই অর্থে ইহা বিস্তৃত। তবে অনেকেই বলিতে পারেন, যে-সব পরিবার কন্যাসন্তান চায় না, খালি হাতে তাহাদের সচেতন করা কঠিন কাজ, বরং সরাসরি আর্থিক সহায়তা দিলে কাজটি ভাল হইবার সম্ভাবনা। ‘সুকন্যা সমৃদ্ধি’ নামক যোজনাটি প্রচলিত হইলেও এখনও তাহার সুদের হার এত কম যে পরিবারগুলিকে আকর্ষণ করা কঠিন হইতেছে। সুতরাং বেটি বচাও প্রকল্পও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নহে। সেই সমালোচনা যতক্ষণ রাজনৈতিক না হইয়া সামাজিক, নেতিবাচক না হইয়া গঠনমূলক— কেন্দ্রীয় সরকার তাহা মন দিয়া শুনিবে, এবং বিবেচনা করিবে, ইহাই প্রত্যাশিত।
দুর্ভাগ্য, তাহার বদলে চলিতেছে নিজের ঢাক পিটানো। প্রণিধানের জায়গায় প্রতিযোগিতা ও আত্মবিজ্ঞাপন। প্রধানমন্ত্রী যদি সত্যই কন্যা-শিশু বিষয়ে সচেতনতার প্রমাণ রাখিতে চান, তাঁহাকে অন্যান্য ক্ষেত্রেও নারী বিষয়ে সমমর্মিতা দেখাইতে হইবে। মাস দুয়েক আগে যখন একটি বলিউড-ফিল্ম বিতর্কের ঝড়ে প্রধান অভিনেত্রীকে নির্যাতন করার শপথ লইতেছিল দেশব্যাপী হিন্দুত্ব ব্রিগেড, হিন্দুত্ব-কৃপাধন্য প্রধানমন্ত্রী কিংবা তাঁহার মন্ত্রীরা একটিও প্রতিবাদবাক্য কহেন নাই। সামাজিক ন্যায় একটি দৃষ্টিভঙ্গি, কাহারও তাহা থাকে, কাহারও থাকে না। যাহার থাকে, তাহার সেই মনোভাব সর্ব ক্ষেত্রে সমান ভাবে প্রকাশ পায়। ক্ষেত্র বিচার করিয়া বিজ্ঞাপন ধ্বনিত করিতে হয় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy