Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

শিক্ষা

কেবল জরুরি অবস্থা জারি করিয়াই নহে, অন্য বহু প্রকারে ইন্দিরা গাঁধী গণতন্ত্রের কাঠামোয় আঘাত করিয়াছিলেন, এই অপ্রিয় সত্য স্বীকার করিবার পরেও ইতিহাস বলিবে, তাঁহার গুরুত্ব বিপুল।

শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

জন্মশতবর্ষে ইন্দিরা গাঁধীকে লইয়া বড় আকারের সমারোহ হয় নাই। হইবার কথাও ছিল না। তাহার একটি কারণ, কেন্দ্রীয় সরকারে এবং দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় রাজ্য সরকারেও ভারতীয় জনতা পার্টির রাজত্ব চলিতেছে। কিন্তু ইন্দিরা গাঁধীর আপন দলের শাসন চলিলেও তাঁহার শতবার্ষিকী অনুষ্ঠান সম্ভবত স্তিমিত থাকিত। তাহার কারণ, এক কথায়, জরুরি অবস্থা। সেই অধ্যায়টি ইতিহাসের পৃষ্ঠায় তাঁহার নামকে স্থায়ী অক্ষরে চিহ্নিত করিয়াছে এবং তাহা স্বর্ণাক্ষর নহে। এই কলঙ্ক বাস্তবিকই অনপনেয়। স্বাধীনতার লগ্নে ও তাহার পরে বেশ কিছুকাল দুনিয়া জুড়িয়া সংশয় ছিল, ভারত তাহার অখণ্ডতা বজায় রাখিতে পারিবে কি না এবং যদি বা পারে, গণতন্ত্রকে বাঁচাইয়া রাখা তো আরও অনেক বেশি কঠিন। জওহরলাল নেহরু এবং তাঁহার সহকর্মীদের নেতৃত্বে স্বাধীন ভারত সেই সংশয়কে ভুল প্রমাণিত করে। গণতান্ত্রিক ভারতের এই সাফল্য উত্তর-ঔপনিবেশিক নয়া দুনিয়া রচনার ইতিহাসে এক অসামান্য দৃষ্টান্ত হিসাবে স্বীকৃত হইয়াছিল। ১৯৭৫ সালের ২৫-২৬ জুন সেই গৌরবে এক তীব্র আঘাত করে, ভারতের মাথা হেঁট হইয়া যায়। এই লজ্জার দায় নামাইয়া রাখিবার কোনও উপায় নাই। ইতিহাস নির্মম।

ইতিহাস বস্তুনিষ্ঠও। কেবল জরুরি অবস্থা জারি করিয়াই নহে, অন্য বহু প্রকারে ইন্দিরা গাঁধী গণতন্ত্রের কাঠামোয় আঘাত করিয়াছিলেন, এই অপ্রিয় সত্য স্বীকার করিবার পরেও ইতিহাস বলিবে, তাঁহার গুরুত্ব বিপুল। বস্তুত, তিনি সেই সব রাষ্ট্রনায়কের অন্যতম, কঠোরতম সমালোচকও যাঁহাদের অগ্রাহ্য করিতে পারে না। ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ হইতে বাংলাদেশ, সবুজ বিপ্লব হইতে ‘গরিবি হটাও’— ভারতীয় শাসনতন্ত্র, অর্থনীতি এবং রাষ্ট্রনীতিতে তিনি গভীর দাগ রাখিয়া গিয়াছেন। তাঁহার ভ্রান্তি ও অন্যায়ের ভিড়ে ইতিবাচক অবদানগুলিকে হারাইয়া ফেলিলে তাঁহার প্রতি অবিচার হইবে। কিন্তু সেই ইতিবৃত্ত বহুচর্চিত, পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। ২০১৭ সালের ভারতে দাঁড়াইয়া একটি কথা বিশেষ প্রাসঙ্গিক। ইন্দিরা গাঁধীর রাজনৈতিক জীবনবৃত্তান্তে নিহিত আছে গণতান্ত্রিক ভারতের পক্ষে একটি মূল্যবান শিক্ষা। গণতন্ত্রের প্রকরণগুলিকে ব্যবহার করিয়া ক্ষমতায় আসিবার পরে অবিসংবাদিত কর্তৃত্বের তাড়নায় রাষ্ট্রনেতা কী ভাবে গণতন্ত্রের ভিত্তিতে আঘাত হানিতে পারেন, সেই শিক্ষা। ইন্দিরা গাঁধীর নীতি ও আচরণের পিছনে তাঁহার স্ব-ভাব কতটা দায়ী ছিল, আর পরিস্থিতি কতখানি, সেই তর্ক চলিতেই পারে, কিন্তু কোনও তর্ক, কোনও যুক্তিই এই সত্য অস্বীকার করিতে পারিবে না যে, তিনি গণতন্ত্রের নীতি হইতে ভ্রষ্ট হইয়াছিলেন। ফাঁকি দিয়া গণতন্ত্র রক্ষা করা যায় না— ইন্দিরা গাঁধীর ইতিহাস ইহাই শিক্ষা দেয়।

পরবর্তী ভারত সেই শিক্ষা গ্রহণ করিয়াছে কি? সরাসরি ‘না’ বলিলে ভুল বলা হইবে। বিচারব্যবস্থার উপর কর্তৃত্বের সুযোগ, সংবিধানের ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করিয়া রাজ্য সরকারকে ফেলিয়া দিবার ক্ষমতা, সাধারণ ভাবে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও প্রতিষ্ঠানগুলিকে অস্বীকার করিবার প্রবণতা— নানা ক্ষেত্রে গত কয়েক দশকে ভারতীয় গণতন্ত্রের আধিপত্য-প্রতিরোধী ক্ষমতা বাড়িয়াছে, নাগরিক সমাজ এবং রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিকতার মূল্য সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন ও সক্রিয় হইয়াছে। ইহার পিছনে সত্তরের দশকের অভিজ্ঞতার ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু যে ‘নিরন্তর সতর্কতা’কে ‘স্বাধীনতার মূল্য’ বলা হইয়া থাকে, তাহার প্রয়োজন যে কখনওই কমিতে পারে না, নরেন্দ্র মোদীর ভারতে তাহাও সমান অনস্বীকার্য। বস্তুত, গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিকতার বিপদ সম্পর্কে ইন্দিরা জমানা যে শিক্ষা দিয়াছে, তাহা এই মুহূর্তে যতখানি মূল্যবান, সেই জমানাতেও বোধ করি ততটা ছিল না। এখানেই তাঁহার ঐতিহাসিক গুরুত্ব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Indira Gandhi Centenary Democracy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE