Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

বিকল্পের নাম উন্নয়ন

পাহাড় সত্যই হাসিল। মুখ্যমন্ত্রীর দিকে চাহিয়া। বহু দিন পর পাহাড়ের কোনও পুরসভায় এমন একটি দল বোর্ড গঠন করিতে চলিয়াছে, যাহা মূলত সমতলের। শুধু মিরিকই নহে, কার্শিয়াং, দার্জিলিং এবং কালিম্পং, তিনটি পুরসভাতেই তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বাড়িয়াছে।

শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

পাহাড় সত্যই হাসিল। মুখ্যমন্ত্রীর দিকে চাহিয়া। বহু দিন পর পাহাড়ের কোনও পুরসভায় এমন একটি দল বোর্ড গঠন করিতে চলিয়াছে, যাহা মূলত সমতলের। শুধু মিরিকই নহে, কার্শিয়াং, দার্জিলিং এবং কালিম্পং, তিনটি পুরসভাতেই তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বাড়িয়াছে। আশা করা যায়, এই জয় আকস্মিক অঘটন নহে। অনেকগুলি দশক ধরিয়া সমতলের সহিত পাহাড়ের যে অসেতুসম্ভব দূরত্ব এবং বিচ্ছিন্নতা তৈরি হইয়াছিল, তাহাকে একটু হইলেও ভাঙা যাইতেছে। গোড়ায় সুবাস ঘিসিং এবং পরবর্তী কালে বিমল গুরুঙ্গ-এর রাজনৈতিক পুঁজিটিই ছিল এই দূরত্ব, সমতলের প্রতি পাহাড়ের অবিশ্বাস। বিশ্বাসের সেই অভাব ভিত্তিহীন ছিল না, উন্নয়নের বৈষম্যের অভিযোগ অকারণ ছিল না। সেই অবিশ্বাস ও অভিযোগের উপর ভর রাখিয়া গোর্খা খণ্ডজাতীয়তাবাদের পরিচিতির রাজনীতি পাহাড়কে ক্রমে সমতল হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়াছিল। সাম্প্রতিক চার পুরসভার ফলাফল বলিতেছে, পাহাড়ের মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসকে অনেকাংশে বিশ্বাস করিয়াছেন। নির্বাচনের ফলাফলের পিছনে দলের সাংগঠনিক ভূমিকা আছে; পাহাড়ের রাজনৈতিক পরিসরে গোর্খা পরিচিতির একাধিপত্য ভাঙিয়া বিভিন্ন উন্নয়ন বোর্ড গঠনের মাধ্যমে অন্য জনগোষ্ঠীগুলির গুরুত্ববৃদ্ধির রাজনৈতিক বিচক্ষণতাও অনস্বীকার্য। আর আছে মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত পরিশ্রম। তাঁহার শাসনকালে পাহাড়ে প্রকৃত উন্নয়ন কতখানি হইয়াছে, তাহার তুলনায় অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হইল, তাঁহার অবিচ্ছিন্ন মনোযোগ পাইয়া পাহাড়ের মানুষ বিশ্বাস করিতে শুরু করিয়াছেন, পাহাড়ে উন্নয়ন সম্ভব, সুস্থিরতা আসা সম্ভব। বিশ্বাসের এই পুনরর্জন নেহাত ফেলনা সাফল্য নহে।

তিনটি পুরসভা দখল করিতে পারিলেও পাহাড়ের নির্বাচনের ফলাফল বিমল গুরুঙ্গকে দুশ্চিন্তায় রাখিবে। এই ফলাফল কেবল অন্য দলের সাফল্যের দিকে নির্দেশ করে না, তাঁহার দলের ব্যর্থতার দিকেও করে। দীর্ঘ দিন রাজনৈতিক একাধিপত্য সত্ত্বেও ইঁহারা পাহাড়ে উন্নয়ন আনিতে পারেন নাই, বরং আন্দোলনের ধাক্কায় পর্যটন ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে। মানুষ হিসাব রাখিতে ভোলেন নাই। গুরুঙ্গদের নিকট পাহাড়ি এলাকার জীবনযাত্রার মান বর্ধনের বহু জরুরি প্রশ্নেরই উত্তর নাই, কিন্তু তাঁহাদের ঔদ্ধত্য আছে আঠারো আনা। মোর্চা নেতাদের একাংশের বিপুল বৈভব, চূড়ান্ত দাপট, অন্তহীন যথেচ্ছাচার তাঁহাদের বিরুদ্ধে গিয়াছে। যাঁহারা ভাতের নিশ্চয়তা দিতে পারেন না, তাঁহারা কিল মারিবার গোসাঁই হইতে চাহিলে কোনও এক সময় প্রতিরোধ তৈরি হইবেই।

এই ফলাফল বলিয়া দেয়, পরিচিতির রাজনীতি কিছু দিনের জন্য অর্থনীতির প্রশ্নগুলিকে ভুলাইয়া রাখিতে পারে বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদে এই রাজনীতির মৌলিক সীমাবদ্ধতা আছে। পাহাড়ে গোর্খা রাজনীতির বর্তমান হালের মধ্যে যে সীমাবদ্ধতার ইঙ্গিত, সাম্প্রতিক সর্বভারতীয় রাজনীতির সহিতও তাহা যথেষ্ট সঙ্গতিপূর্ণ। উত্তরপ্রদেশেও কিন্তু শেষ অবধি যাদব বা দলিত, কোনও পরিচিতিই ভোটবাক্সে একটি সময়ের পর সাফল্য আনিয়া দিতে পারে নাই। পরিচিতির রাজনীতির সহিত উন্নয়নের কার্যক্রমের মেলবন্ধন থাকা দরকার, নতুবা শুধু প্রথম কারণটি অনন্ত কাল রাজনৈতিক পুঁজি ধরিয়া রাখিতে পারে না। উল্লেখ্য, নীতীশ কুমারও মহাদলিত পরিচিতির রাজনীতিকে উন্নয়নের রেটরিকে মুড়িয়াছিলেন। আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার রাজনীতি করিতে গিয়া ওই বিশেষ জনগোষ্ঠীর নিকট, এবং বৃহত্তর অর্থে গোটা রাজ্যের জন্য, উন্নয়নের ব্যবস্থা করাই তাঁহার রাজনৈতিক ভাষ্য ছিল। বিমল গুরুঙ্গদের রাজনীতিতে এই উত্তরণ দেখা যায় নাই। সুতরাং, পুরভোটে পাহাড়ের মানুষ বলিয়া দিয়াছেন, তাঁহারা বিকল্প খুঁজিতে জানেন। সেই বিকল্পের নাম উন্নয়ন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Development Voters
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE