Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
চিনের কথা ভেবেই মায়ানমার প্রশ্নে ভারত সতর্ক

কূটনীতি বরাবরই নির্দয়

কূটনীতি জিনিসটা বরাবরই নির্দয়। আর তার সঙ্গে যদি জড়িত থাকে ভূ-কৌশলগত রাজনীতি ও অর্থনৈতিক স্বার্থ, তবে তো কথাই নেই।

পাশে: মায়ানমার সফরে সু চি-র মুখোমুখি নরেন্দ্র মোদী। ইয়াঙ্গন, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭। ছবি: পিটিআই

পাশে: মায়ানমার সফরে সু চি-র মুখোমুখি নরেন্দ্র মোদী। ইয়াঙ্গন, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭। ছবি: পিটিআই

পলাশ পাল
শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০১
Share: Save:

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক মনে করে। তাই দেশ থেকে তাদের বিতাড়িত করতে চায়। প্রায় পাঁচ লক্ষের বেশি বাস্তুচ্যুত মানুষ আশ্রয় নিয়েছে প্রতিবেশী বাংলাদেশে। এবং অস্বীকার করার উপায় নেই, নির্যাতিত রোহিঙ্গারা সীমান্তে যে ভাবে ভিড় করছে, তাতে কিছু পরিমাণে সতকর্তা অবলম্বন করা অবশ্যই জরুরি। কিন্তু তাই বলে একটি রাষ্ট্রহীন সম্প্রদায়ের সদস্যদের নিরাপদ আশ্রয় কেড়ে নেওয়া এবং তাদের সন্ত্রাসবাদী হিসাবে দেগে দেওয়া সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত। স্বাভাবিক কারণেই উদ্বাস্তুদের বিরুদ্ধে সরকারের এহেন অবস্থান আমাদের ব্যথিত, ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত করেছে।

তবে কিনা, কূটনীতি জিনিসটা বরাবরই নির্দয়। আর তার সঙ্গে যদি জড়িত থাকে ভূ-কৌশলগত রাজনীতি ও অর্থনৈতিক স্বার্থ, তবে তো কথাই নেই। নৈতিকতা, মানবিকতার মতো বিষয়গুলি নিয়ে নাগরিক সমাজ যতই উদ্বিগ্ন হোক না কেন, শাসকের কাছে তখন সেটা গৌণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। মায়ানমার প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এবং দেশটির ভূ-কৌশলগত অবস্থানও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি যেমন এক দিকে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে, অন্য দিকে এটি ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরেরও একটি দেশ। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে স্থলপথে সংযোগ স্থাপনের যে কোনও প্রচেষ্টা মায়ানমারের উপর দিয়ে হতে হয়। দেশটির সঙ্গে স্থল-সীমান্ত সম্পর্ক রয়েছে ভারত, চিন, বাংলাদেশ, লাও ও তাইল্যান্ডের। এ রকম একটা দেশকে নিয়ে এশিয়ার দুই উদীয়মান শক্তি, চিন ও ভারতের টানাপড়েন স্বাভাবিক। বিশেষত, মায়ানমার-সহ দক্ষিণ এশিয়া ও তার সংলগ্ন অঞ্চলে চিনের প্রভাব ক্রমবর্ধমান। তথাকথিত ‘মুক্তোর মালা’ দিয়ে ভারতকে সে ধীরে ধীরে আবদ্ধ করে ফেলছে। এই অবস্থায় সাউথ ব্লকের পক্ষে হাত গুটিয়ে থাকা অসম্ভব।

সীমান্ত সমস্যা থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, বিভিন্ন বিষয়েই দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চিন ও ভারতের বর্তমান নীতি হল পরস্পরের ক্ষেত্রে ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচ্যগ্র মেদিনী’। ডোকলামের সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে এই অভিব্যক্তিই প্রকট হয়েছে। তবে ব্রিকস সম্মেলন উভয় দেশকে শান্তিপূর্ণ ভাবে সংকট থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ করে দিয়েছিল। পাশাপাশি এটাও ঠিক, ডোকলামের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে উভয়েই এখন আরও সতর্ক। ব্রিকস সম্মেলনের এক সপ্তাহ অতিক্রম না করতেই সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়ত বলেছিলেন, চিন ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দুই ফ্রন্টে যুদ্ধ অসম্ভব নয় (এর আগে তিনি আড়াইখানা ফ্রন্টে লড়াই করার কথা বলেছিলেন)। তিনি চিনের বিরুদ্ধে ‘সালামি স্লাইসিং’ (ধীরে ধীরে দখল করে নেওয়া)–এর অভিযোগও করেন। প্রায় একই কথা বলেন সেনাবাহিনীর দক্ষিণ কমান্ডের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল পি এম হারিজ: ডোকলামই শেষ নয়, সামরিক সতর্কতা ধরে রাখতে হবে। পরে রাওয়ত তাঁর বক্তব্য সংশোধন করেন বটে, কিন্তু এগুলিকে হালকা করে দেখার উপায় নেই। চিন-ভারত সীমান্ত প্রশ্ন, বাণিজ্য যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যতে এই অঞ্চল আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠবে।

শুরু থেকেই রোহিঙ্গা সমস্যাকে মায়ানমারের ‘অভ্যন্তরীণ সংকট’ বলে অভিহিত করেছে চিন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। চিনের এই অবস্থানের কারণে সাউথ ব্লকের মনে আশঙ্কা তৈরি হয় যে, ভারত মায়ানমারের সামরিক বাহিনী ও সু চি-র নিন্দা করলে দেশটিকে আরও বেশি করে বেজিংয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে। অথচ, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চিন-ভারত দ্বৈরথ যত তীব্র হচ্ছে, চিন তার আধিপত্য বলয় তৈরি করছে, তার মোকাবিলা করতে মায়ানমারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়া জরুরি। আসিয়ান-ভুক্ত দেশগুলির সঙ্গে ভারতের ভৌগোলিক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যমও মায়ানমার। নরেন্দ্র মোদীর সাধের ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির বাস্তবায়নের জন্যও নেপিদ-এর সঙ্গে দিল্লির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ জরুরি। আবার, উত্তর-পূর্ব ভারতের যে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলি মায়ানমারের জঙ্গলে আশ্রয় নেয়, তাদের দমন করতেও সাউথ ব্লকের দরকার মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর সহায়তা।

তবে মায়ানমারের সঙ্গে নয়াদিল্লির তুলনায় বেজিংয়ের সম্পৃক্ততা অনেক গভীর। পৃথিবীর ৬৮টি দেশকে যুক্ত করে যে বিশাল ও অতি-উচ্চাকাঙ্ক্ষী ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ প্রকল্প চিন হাতে নিয়েছে, মায়ানমার তার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত রাখাইন অঞ্চলেই সে গড়ে তুলছে একটি সমুদ্রবন্দর, এখান থেকে সংগৃহীত গ্যাস-তেল সরাসরি রফতানি হবে চিনে। পশ্চিম এশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানির জন্য ব্যস্ত মালাক্কা প্রণালী এড়াতে এখানেই নির্মিত হচ্ছে আন্তঃসীমান্ত তেল ও গ্যাস পাইপলাইন। চিনের মদতে একটি মুক্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনাও নিয়েছে মায়ানমার সরকার। রাখাইন রাজ্যের কিয়ুকপিয়ুতে অবস্থিত এই বিশেষ শিল্পাঞ্চলে নির্মীয়মাণ বন্দরের মাধ্যমে মায়ানমারে বেজিংয়ের নৌ-উপস্থিতি আরও প্রবল হবে। অস্ত্র, খাদ্যশস্য, বস্ত্র— চিন থেকে মায়ানমারের আমদানির তালিকাও দীর্ঘ। একটি হিসাবে, ১৯৮৫ থেকে ২০১৫, মায়ানমারে ১২৬টি প্রকল্পে চিন বিনিয়োগ করেছে প্রায় ১৫ বিলিয়ন বা ১৫০০ কোটি ডলার।

মায়ানমারে ভারতের বিনিয়োগ ও বাণিজ্য চিনের তুলনায় অনেকটাই কম। তবে নয়াদিল্লি তা বাড়াতে চায়। রাখাইন রাজ্যের সিত্তুই-এ একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে ভারত। ভারত-মায়ানমার-তাইল্যান্ড ‘এশিয়ান ট্রাইল্যাটরাল হাইওয়ে’ নির্মাণের পরিকল্পনাও রয়েছে ভারতের। এটি মায়ানমারের মাধ্যমে মিজোরাম ও তাইল্যান্ডকে সংযুক্ত করবে। রয়েছে কালাদান বহুমুখী প্রকল্প এবং সড়ক ও নদীপথে পণ্য পরিবহণের পরিকল্পনা। ভারতের নেতৃত্বে ‘বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকনমিক কোঅপারেশন’ (বিমস্টেক)-এরও গুরুত্বপূর্ণ অংশ মায়ানমার। ২০১৫-১৬ সালে ভারত-মায়ানমার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ছিল ২.০৫ বিলিয়ন (২০৫ কোটি) ডলার। অনুমোদিত প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ ৭৩০ মিলিয়ন (৭৩ কোটি) ডলার। ২২টি ভারতীয় কোম্পানি এই অর্থ বিনিয়োগ করেছে।

সাউথ ব্লকের কর্তরা ভালই জানেন, রোহিঙ্গা প্রশ্নে সু চি-র দিকে দিল্লির ঝুঁকে থাকা সমগ্র বিশ্বে সমালোচনার ঝড় তুলবে। ক্ষুব্ধ করবে বাংলাদেশকে। ইতিমধ্যেই ঢাকা মায়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টির জন্য নয়াদিল্লিকে অনুরোধ করেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের নিজের অবস্থান বজায় রাখতে সাউথ ব্লকের ঢাকাকেও খুবই প্রয়োজন। কিন্তু প্রতিপক্ষ যেখানে চিন, সেখানে কার্যত তার হাত-পা বাঁধা। তাই দু’দিক সামলানোর তাগিদে মোদী সরকার এক দিকে বাংলাদেশে আশ্রিত শরণার্থীদের মানবিক ত্রাণ সরবরাহ করছে, অন্য দিকে সু চি-র প্রতি অবিচল আস্থা রেখেছে।

মায়ানমারে চিন ও ভারতের তুলনায় অল্প হলেও অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নেরও। তাই তারাও মায়ানমারের বিরুদ্ধে মৃদু ভর্ৎসনার বেশি কিছু করতে আগ্রহী নয়। অনুমান করা যায়, নিরাপত্তা পরিষদে দেশটির বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপের বিরোধিতা করে চিনের সঙ্গে রাশিয়াও ভেটো দেবে। অরগানাইজেশন অব ইসলামিক কান্ট্রিজ-এর অন্তর্ভুক্ত দেশগুলির মধ্যে তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া যেটুকু সরব হয়েছে, তার পিছনেও রয়েছে ইসলামি বিশ্বে মানবিক মুখ হিসাবে তুলে ধরার কূটনীতি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সৌদি আরবকে ইসলামি বিশ্বের নেতৃত্ব থেকে হটানোর উদ্দেশ্যেই তুরস্ক এ ক্ষেত্রে এতটা মুখর।

এই পরিস্থিতিতে সকলেই নিজ নিজ স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেবে, বলার অপেক্ষা রাখে না। একটা দেশে যতই সংগঠিত জাতিগত নিধন চলুক, একুশ শতকের দুনিয়ায় পুঁজির স্বার্থ রক্ষা করাই কূটনীতির আসল ধর্ম। ও সব মানবিকতা নিয়ে ভাবার অবকাশ কোথায়! ভরসা একটাই, হাতের কাছে এখনও বাংলাদেশ রয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE