Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

ডাক্তার ও রোগী

নামী-দামি অসরকারি হাসপাতালের প্রতিনিধিদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভাষায় যে ভাবে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন তা মোটের ওপর আমজনতার মনের কথা।

অ-সহায়। এই দৃশ্য কেন এত বেশি পরিচিত?

অ-সহায়। এই দৃশ্য কেন এত বেশি পরিচিত?

বিশ্বজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

নামী-দামি অসরকারি হাসপাতালের প্রতিনিধিদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভাষায় যে ভাবে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন তা মোটের ওপর আমজনতার মনের কথা। শান্ত-ঠান্ডা-পরিশীলিত বহুমূল্য স্বাস্থ্যব্যবস্থার দাপট সামলাতে গিয়ে রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন না অথচ ‘পেশেন্ট পার্টি’কে ঘটিবাটি বিক্রি করে দিতে হয়, অনেকেরই এ অভিজ্ঞতা হয়েছে। কোনও তত্ত্বকথা না আউড়ে সোজাসাপটা ভাষায় স্বাস্থ্য-পরিষেবার দশচক্রে সব-হারানো মানুষদের মনের কথা মুখ্যমন্ত্রী তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে, কাটা কাটা বাক্যে শুনিয়ে দিয়েছেন। তাঁর ভঙ্গি ও অভিযোগের মধ্যে কোনও রাখঢাক নেই। পশ্চিমবঙ্গের শিল্পের ভবিষ্যৎ, অর্থনীতির অবস্থা, প্রশাসনের পরিকল্পনা বিষয়ে তিনি যখন একই ভঙ্গিতে কথা বলেন তখন নাগরিকদের অনেকেরই কেমন কেমন লাগে। মুখ্যমন্ত্রী যতই সরাসরি সোজা পথের নিদান দিন না কেন, অনেকেরই সে সব ঠিক বিশ্বাস হতে চায় না। যে ভাবে খুব কম আয়োজনে আলু কিনে সেদ্ধ করে মশলাদার মুখরোচক চপ বানিয়ে খাওয়া যায়, সেই প্রত্যক্ষ সহজ পথে শিল্প-অর্থনীতি-প্রশাসন চলে না।

স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে তাঁর সোজাসাপটা কথাগুলি শুনে কিন্তু মনে হচ্ছে, আহা এমন হলে বেশ হয়, আমাদের শরীর-মন-টাকা সব বাঁচে। শিল্প-অর্থনীতি-প্রশাসন ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গে মানুষের ব্যক্তিগত শরীর-মনের ভাল থাকা মন্দ থাকার বিষয়টি খানিকটা ঘুরপথে সম্পর্কিত, মাঝখানে নানা অঙ্গ-উপাঙ্গ থাকে। স্বাস্থ্যের ব্যাপারটা অন্য রকম, খুব কালান্তক ব্যাধি না-হলে, অসুস্থ মানবশরীরটি ডাক্তারবাবুর যত্নে ও চিকিৎসায় একটু একটু করে বা দ্রুত ভাল হয়ে উঠছে কি না, তা পরিজনদের প্রত্যক্ষগোচর হওয়ার কথা। ডাক্তারবাবু যত্ন করে দেখে রোগীদের সুস্থ করবেন এই চাহিদাটুকুই মুখ্যমন্ত্রীর বাক্যে সাধারণ মানুষদের হয়ে উঠে এসেছে, তাই ভাল লাগছে।

যে বহুমূল্য অথচ প্রাণঘাতী স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার প্রতি নিরুপায় সাধারণ মানুষের ও মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষোভ, একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, তা অসুস্থ মানুষ ও চিকিৎসকের মধ্যে নানা ‘উপকরণ’ ঢুকিয়ে দিয়েছে। কয়েক দশক আগেও চিকিৎসা ব্যবস্থায় ডাক্তারবাবুর সঙ্গে অসুস্থ মানুষটির যে স্বাভাবিক প্রত্যক্ষ সম্পর্ক তৈরি হত এখন তা আর হওয়ার উপায় নেই। অসরকারি হাসপাতালের ব্যবস্থাধীন ডাক্তারবাবু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগীর ‘ধাত’ জানেন না, অসুস্থ মানুষটির রোগের ইতিহাস-ভূগোল জানবার আগ্রহ খুব একটা দেখান না। শীতল-পরিশীলিত ব্যবস্থাপনায় কতগুলি খরচসাপেক্ষ যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনাকে কায়েম করার আদেশ দেন মাত্র। সেই আদেশ ও নির্দেশ কাজ করলে ভাল, কাজ না-করলে রোগীর ধাত বুঝে ব্যক্তিগত উদ্যোগে অসুস্থ মানুষটিকে সুস্থ করে তোলার জন্য প্রাণপাত হাতে গোনা চিকিৎসকই করেন। অধিকাংশ চিকিৎসক পুঁজিনির্ভর মুনাফাবর্ধক হসপিটাল-ম্যানেজমেন্টের অনুগত অংশীদার। ফলে অনেক সময় শরীরের ওপর যা করার দরকার নেই, টাকার জন্য তাও করা হয়। অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষার শিকার হন মানুষ, আর হেলথ ইনশিওরেন্স আছে বললে তো কথাই নেই। বিল ক্রমবর্ধমান, ভাবখানা এই যে ইনশিওরেন্সের কিস্তি যেন মানুষটিকে দিতে হয় না, গৌরী সেন দেন। আসলে ইদানীং চিকিৎসার কায়দাটা রোগ আর রোগীর চেয়ে এত বেশি বড় যে, অসুস্থ মানুষটিকে প্রায় দেখাই যায় না; মনে হয়, তাকে না দেখলেও চলে। চিকিৎসার অসরকারি খাঁচায় টিভি থাকে, চিত্তের উদ্বেগ উপশমকারী নরম সুর ধ্বনিত হয়, ডেস্কে ডেস্কে সুবেশী তরুণী ও সুবেশ তরুণেরা— বিনোদনের অভাব নেই, দেখলে শরীরে রোমাঞ্চ হয়। এই সব উপকরণের দাম আছে, নানাবিধ যন্ত্র বসানোর লগ্নি আছে, মরে যাওয়ার পর কিংবা সেরে ওঠার পর পর্যাপ্ত টাকাপয়সার ব্যবস্থা না করলে চলবে কেন !

স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে মানুষের সঙ্গে মানুষের এক রকম বিযুক্তি তৈরি হয়েছে। ডাক্তার রোগীকে চেনেন না— তাঁরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন। মাঝখানে এসেছে ব্যয়সাপেক্ষ নানা অহেতুক উপাদান। সংকটের উৎপত্তি সেখান থেকেই। কেন এমন হল? এই অসরকারি বহুমূল্য উপকরণের পথ প্রস্তুত করেছিল রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষণায় গড়ে ওঠা সরকারি অব্যবস্থা। জেলায় জেলায় চিকিৎসকরা যেতে চাননি, গেলেও হাজির থাকেননি হাসপাতালে। কলকাতা শহরেও সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের দেখা মেলেনি। দল ও দলীয় দাদাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলে, দলচর হলে সরকারি ডাক্তারবাবুদের অসুবিধেজনক জায়গায় যেতে হয় না, কলকাতার হাসপাতালে হাজির না থেকেও বেতন পাওয়া যায়। এই সত্য এমন ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে, গোটা রাজ্যেই সরকারি ডাক্তারবাবুরা সুবিধে পেতেই মগ্ন ছিলেন।

ডাক্তারবাবুদের দেখাদেখি অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরাও এই ব্যক্তিগত লাভের অঙ্কই কষছিলেন। পার্টি ও দালাল এরই মধ্যে সরকারি ব্যবস্থার সুবিধেটুকু হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। ফলে মধ্যবিত্ত-উচ্চমধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত যাঁরা নব্বইয়ের মুক্ত-অর্থনীতির সৌজন্যে ক্রমশ ক্রয়ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে উঠলেন তাঁদের চাহিদা মেটানোর জন্য হাসি-হাসি মুখে ক্রমশ ‘ফিল গুড’ অসরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রসার হল। প্রসঙ্গত, শিক্ষার ক্ষেত্রেও মোটের ওপর একই গল্প। উপকরণ ও টাকাই সেখানে ক্রমশ প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠেছে। ক্রয়ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষের মুখের হাসিও মিলিয়েছে, যতই ভারতকে ভুলে তাঁরা ইন্ডিয়ার বাসিন্দা হয়েছেন ভাবুন না কেন, টাকা তো আর অঢেল নয়। এই ব্যবস্থা হাসি হাসি মুখে মানুষের সর্বনাশ করতে দ্বিধা করল না।

উপকরণসর্বস্ব স্বাস্থ্যসমস্যাকে মুখ্যমন্ত্রী সহজে আক্রমণ করেছেন, করতে পেরেছেন তার একটা কারণ— যে রাজনীতিতে তাঁর বিশ্বাস সেখানে তিনিই সব। সরাসরি নিজেই একা হাতে সব করতে চান। মুখ্যমন্ত্রীর অপ্রত্যক্ষ প্রশাসনিক ভূমিকার থেকে সরাসরি পথে নেমে পড়াই তাঁর বেশি পছন্দের। পলিটব্যুরোর ভূত তাঁর রাজনীতিকে দখল করে না। এর ভাল-মন্দ দুইই আছে। অসরকারি স্বাস্থ্যক্ষেত্রকে হুঁশিয়ারি দেওয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে দলের মধ্যে কোনও শীতল অধিবেশন করতে হয়নি। তবে সরাসরি হুঁশিয়ারিটুকুই তো সব কথা নয়। স্বাস্থ্যক্ষেত্রের নিয়োগে দলতন্ত্রের ভূতটিকে দমন করতে না পারলে, সরকারি স্বাস্থ্যপরিকাঠামো যথাযথ ভাবে গড়ে না তুললে অসরকারি উপকরণের গলাকাটা নৃত্য বন্ধ হবে না। মুখ্যমন্ত্রীর কথার সঙ্গে পরবর্তী পদক্ষেপের সামঞ্জস্য থাকে কি না এখন সেটাই দেখার।

লেখক বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE