Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

চাই সংযত সতর্কতা

অসরকারি সংস্থাগুলির উপর নজরদারির জন্য কেন্দ্রকে আইন করিবার পরামর্শ দিল সুপ্রিম কোর্ট। কারণ যে সকল সংস্থা সরকারি অনুদান লইয়া থাকে, তাহার অধিকাংশ হিসাব দাখিল করে না। মাঝেমাঝে কিছু সংস্থাকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়।

শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০১৭ ০০:৩৩
Share: Save:

অসরকারি সংস্থাগুলির উপর নজরদারির জন্য কেন্দ্রকে আইন করিবার পরামর্শ দিল সুপ্রিম কোর্ট। কারণ যে সকল সংস্থা সরকারি অনুদান লইয়া থাকে, তাহার অধিকাংশ হিসাব দাখিল করে না। মাঝেমাঝে কিছু সংস্থাকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। কিন্তু সংস্থার অনুমোদন বাতিল বা সরকারি অনুদান বন্ধ করিলে সামান্যই প্রতিকার হয়। সরকারি নানা প্রকল্প রূপায়ণের ভার থাকে এই অসরকারি সংস্থাগুলির উপর। প্রকল্পের টাকা অব্যবহৃত পড়িয়া থাকিলে বা চুরি হইলে বহু মানুষ অতি প্রয়োজনীয় পরিষেবা হইতে বঞ্চিত হয়। এ রাজ্যেই তাহার উদাহরণ কম নাই। সম্প্রতি শ্রমজীবী মহিলাদের শিশুসন্তানদের জন্য ক্রেশগুলির প্রায় অর্ধেকের অনুদান বন্ধ করিয়াছে কেন্দ্র। অভিযোগ, এগুলির পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত অসরকারি সংস্থাগুলি সময়মতো হিসাব পাঠায় নাই। কখনও অভিযোগ আরও ভয়ানক। যে সংস্থাগুলি অনাথ শিশু দত্তক দেয়, মানসিক রোগীদের হোম চালায়, প্রতিবন্ধীদের বিদ্যালয় বা হস্টেল পরিচালনা করে, তাহাদের অব্যবস্থা ও দুর্নীতির জন্য অসহায় মহিলা ও শিশুদের প্রাণহানি, পাচার, নির্যাতন ঘটিয়াছে। সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানে রক্ষকই ভক্ষক হইয়া উঠিয়াছে, এমন দৃষ্টান্ত কম নাই।

অতএব উচ্চতম আদালত যে নজরদারির নির্দেশ দিয়াছে, তাহাতে বিস্ময়ের কিছু নাই। আশ্চর্য এই যে এত দিন সে ব্যবস্থা হয় নাই। সেই ফাঁক আইনের অভাবে কি না, তাহা অবশ্য ভিন্ন প্রশ্ন। জনগণের টাকায় যে অনুদানের সংস্থান হয়, সেই টাকা বাস্তবিক জনস্বার্থে খরচ হইয়াছে কি না, তাহা দেখিবার অধিকার যে সরকারের অবশ্যই আছে। তাহার জন্য আইন প্রণয়নের প্রয়োজন নাই। বরং এ ক্ষেত্রে আরও একটু আগাইয়া বলা যায়, স্বদেশ ও বিদেশ হইতে অসরকারি অনুদানে যাহারা কাজ করিতেছে, তাহারাও আইনের শাসন মানিয়া, সংবিধান-নির্দিষ্ট গণতান্ত্রিক আদর্শগুলির প্রতি শ্রদ্ধা রাখিয়া কাজ করিতেছে কি না, তাহা দেখাও সরকারের কর্তব্য। অন্যতম প্রধান কর্তব্য বলিলেও অত্যুক্তি হয় না।

কিন্তু সরকারের কর্তব্যের সীমা সরকারের অধিকারেরও সীমা। নজরদারি যদি নিয়ন্ত্রণের উপায় হইয়া ওঠে, তাহা আর এক সংকট হইয়া ওঠে। ভুলিলে চলিবে না, অসরকারি সংস্থাগুলি নাগরিক সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সরকার হইতে স্বাতন্ত্র্য তাহাদের মৌলিক চরিত্র। সরকারি অনুদান পাইয়া সরকারি প্রকল্পে কাজ করিবার রীতি আপাতদৃষ্টিতে যেমন অসরকারি সংস্থাগুলিকে পুষ্ট করিয়াছে, তাহাদের সংখ্যা বাড়াইয়াছে, তেমনই অসরকারি সংস্থার কর্মীদের সরকারি দফতরগুলির অস্থায়ী কর্মীতে পরিণত করিতেছে। ইহাতে অসরকারি সংস্থাগুলির মৌলিক চরিত্রটি নষ্ট হইয়া যায়। অসরকারি সংস্থাগুলি বিচিত্র কাজ করিলেও তাহাদের মৌলিক উদ্দেশ্য স্বচ্ছ, দায়বদ্ধ, গণতান্ত্রিক প্রশাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন। সত্তরের দশক হইতে গোটা বিশ্বে এই ধারণার ভিত্তিতে নাগরিক সমাজ ক্রমে শক্তিশালী হইয়াছে। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে যে ফাঁকগুলি রহিয়া যায়, নাগরিকের যোগদান ও জনমত-ভিত্তিক কার্যসূচি দ্বারা নাগরিক সমাজ তাহা পূর্ণ করিতে চাহে। জনজীবনে রাষ্ট্রের দখলদারি প্রতিহত করিবার কাজটিও তাহার। সেই নিরিখে অসরকারি সংস্থাগুলি একই সঙ্গে রাষ্ট্রের প্রতিস্পর্ধী এবং পরিপূরক। ব্যক্তি নাগরিকের সহিত রাষ্ট্রের দ্বন্দ্বময় সম্পর্কটির মধ্যস্থলে রহিয়াছে নাগরিক সমাজ। তাহার অংশীদার হিসাবে অসরকারি সংগঠনগুলির স্থানও সেখানে। হিসাব লইবার ছলে রাষ্ট্র জ্যেষ্ঠতাত সাজিয়া বসিলে এই ভারসাম্যের যে ক্ষতি হইবে, তাহা রাজকোষের অর্থ অপচয়ের ক্ষতি ছাড়াইয়া যাইবে। অতএব সংযত থাকিয়া নজর রাখুক সরকার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Supreme Court
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE