Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

শিক্ষা তো বাজারের পণ্য নয়

কারণটা খুবই স্বচ্ছ। ছাত্ররা প্রেসিডেন্সিতে আসত তখন শিক্ষার জন্য, চাকরির ভিত তৈরি করার জন্য নয়। উচ্চ মার্গের শিক্ষার তখন একটা কদর ছিল সমাজে, যেটা এখন পরিপূর্ণ ভাবে লোপ না পেলেও, সে-মর্যাদার চাহিদা এখন খুবই কম।

বিকাশ সিংহ
শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০১৮ ০০:০৬
Share: Save:

খবরের বাজারে আবার তীব্র আলোচনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে— প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান একেবারে রসাতলে যাচ্ছে। যে প্রেসিডেন্সি একদিন জগৎসভায় প্রথম সারিতে ছিল, সেই প্রেসিডেন্সিতে এখন সিট খালি পড়ে থাকে, ছাত্ররা অন্য শিক্ষাকেন্দ্রে চলে যাচ্ছে ইত্যাদি। প্রেসিডেন্সি যখন প্রথম সারিতে, সেই সময় সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, ছাত্রদের চিন্তাধারা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিচারবুদ্ধি, সবই অন্য রকম ছিল আজকের তুলনায়। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে আইআইটি-তে যে ছাত্ররা ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল, তাদের অনেকেই প্রেসিডেন্সিতে আসার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করত।

কারণটা খুবই স্বচ্ছ। ছাত্ররা প্রেসিডেন্সিতে আসত তখন শিক্ষার জন্য, চাকরির ভিত তৈরি করার জন্য নয়। উচ্চ মার্গের শিক্ষার তখন একটা কদর ছিল সমাজে, যেটা এখন পরিপূর্ণ ভাবে লোপ না পেলেও, সে-মর্যাদার চাহিদা এখন খুবই কম। এখন আইআইটি-র সংখ্যা প্রচুর বেড়েছে। বর্তমানের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আইআইটি-র ছাত্রদের মানসিকতা বেশ সুন্দর মিলে যায়। আবার আইআইএসইআর, এনআইটি-র সংখ্যা কম নয়। এখান থেকে সবচেয়ে ভাল ছাত্ররা বিদেশে পাড়ি দেয়। বড়-বড় কোম্পানিতে যথেষ্ট উঁচুতে ওঠে। আমরা দেশ থেকে তাঁদের বাহবা জানাই। মোদ্দা কথা, মোটামুটি বেশ ভাল সংখ্যক ছাত্র আধুনিক ধাঁচের কোম্পানিতে অনায়াসে ঢুকে পড়ে। মোটা মাইনে, বাবা-মা খুশি, বিয়ের বাজার গরম, কম বয়সের মধ্যেই তারা গাড়ি, বাড়ি, ছুটি— সবই জুটিয়ে নেয়, যেগুলি বর্তমান যুগের উন্নতির মাপকাঠি। পঞ্চাশ বছর আগের সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে আজকের সমাজকে চেনা কঠিন। শিক্ষার নিজস্ব মর্যাদা কমেছে, বাজারে এখন টাকা উপার্জনের অঙ্কটাই একমাত্র পরিচিতি হয়ে উঠেছে।

প্রেসিডেন্সি কিন্তু চিরকালই, এমনকী আজকেও, ক্লাসিক্যাল শিক্ষার প্রতিষ্ঠান, যে-কোনও বিষয়ে, বিজ্ঞান, সাহিত্য, অর্থনীতি, ভাষা। কাজেই এটা একেবারেই অস্বাভাবিক নয় যে, যখন প্রেসিডেন্সি সাফল্যের শিখরে, সেই যুগে বিভিন্ন বিষয়েই যুগান্তকারী অধ্যাপকদের আবির্ভাব হয়েছে। সেই শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য, জ্ঞানের আলোয় নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়া। মানুষের ব্যক্তিত্ব সেই শিক্ষার ছটায় ঝলমলে হয়ে ওঠে— যার মধ্যে কোনও ধান্দা নেই। পদার্থবিদ্যায় অমল রায়চৌধুরী, ইংরেজি সাহিত্যে তারক সেন, অর্থনীতিতে তাপস মজুমদার ছাত্রদের প্রেরণার প্রাণস্পন্দন জুগিয়েছিলেন।

আজকের দিনে শিক্ষার একটা ন্যূনতম মান রাখতে গেলে সব আসন যে ভরা যাবে না, সেটাই তো স্বাভাবিক। শিক্ষা তো হাটবাজার নয়। ক্লাসিক্যাল শিক্ষার চাহিদা হয়তো এখন একটু কমের দিকে, কিন্তু চিরকালই থাকবে না। এই ক্লাসিক্যাল শিক্ষা থেকেই তো সভ্যতার ভিত তৈরি হয়। ইংল্যান্ডে অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ চিরকালই থাকবে, মার্কিন দেশে হার্ভার্ড, প্রিন্সটনও থাকবে, তেমনই পশ্চিমবঙ্গে একটা কেন, দু’তিনটে প্রেসিডেন্সি থাকা উচিত।

কিন্তু আর একটা সমস্যা উঠে এসেছে, শিক্ষাকেন্দ্রের আনাচকানাচে। সেটা হল সস্তার স্লোগান চেঁচিয়ে পরিবেশকে দূষিত করা, বিশেষত কোনও বিশেষ উপলক্ষে। শুধুমাত্র ছাত্ররাই এর মধ্যে আছে বলে মনে করি না। ছাত্রদের উসকানি দেওয়ার লোকের অভাব নেই। যেমন রবীন্দ্রনাথ প্রত্যেক বাঙালির নিজস্ব রবিঠাকুর, ঠিক তেমনই শিক্ষিত বাঙালির প্রেসিডেন্সি। তাঁরা সব জেনে বসে আছেন, কোনটা ভাল, কোনটা খারাপ, ঠিক বাঙালি মায়েদের মতো। সন্তানের ভাল-মন্দ তাঁরাই সবচেয়ে ভাল বোঝেন। এই উসকানির আগুন জ্বলছে প্রেসিডেন্সিতে— এই সব দেখে ছাত্ররা, যারা পরের জীবনে ‘দাদাগিরি’ করে দিন কাটাতে চায় না, তারা শান্তিপ্রিয় অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতির হাওয়া তো থাকবেই, কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে উসকানিনীতির সংযোগ হলে বোমা তৈরি হয়, সলতেটা যার জ্বলছে। একটুতেই বোমা ফেটে একাকার হয় এবং হচ্ছেও।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটেও রাজনীতির প্রচণ্ড আলোচনা হয়, কিন্তু সেটা বিদ্যার পর্যায়েই, স্লোগান-বিজ্ঞানের নয়। এই তথাকথিত আন্দোলন, স্লোগান-বিজ্ঞান বন্ধ করতে না পারলে আমাদের সব আশার ফুল আর ফুটবে না।

বাঙালির আর আছেটা কী? বাংলায় বাঙালি সভ্যতা, বাঙালি প্রতিষ্ঠান, বাঙালি শিল্প সবই নিম্নমুখী। কিন্তু আত্মঘাতী বাঙালি শিক্ষাকে প্রাণপণে ধরে রেখেছিল। শিক্ষাই বাঙালির একমাত্র সম্পদ। সেই শিক্ষা থেকে বাঙালিকে বঞ্চিত করলে বাঙালি কাঙাল হবে। তাই বলি, বাঙালিকে বাঁচাতে গেলে প্রথমেই বাংলার শিক্ষাকে বাঁচান। তবেই সে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনে বসবে।

ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টার-এ হোমি ভাবা চেয়ার প্রফেসর

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Presidency University Education Marketisation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE