পার্থ চট্টোপাধ্যায়।
শিক্ষামন্ত্রী জানাইয়াছেন, গায়ের জোরে শিক্ষকদের উপর কোনও আচরণবিধি চাপাইয়া দেওয়া হইবে না। দফতরের দায়িত্ব পাওয়া ইস্তক যিনি ‘পয়সা দিই, তাহা হইলে ছড়ি ঘুরাইব না কেন’-র দর্শনে বিশ্বাস করিয়া আসিয়াছেন, এবং নির্দ্বিধায় সেই বিশ্বাসের কথা রাষ্ট্র করিয়া বেড়াইয়াছেন, সেই শিক্ষামন্ত্রীর গলায় এ হেন নরম সুরকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়াই বিধেয়। একই সঙ্গে স্মরণ করাইয়া দেওয়াও প্রয়োজন যে শিক্ষকদের উপর এমন মারাত্মক আচরণবিধি আরোপ করিবার প্রস্তাব যে উঠিয়াছে, তাহাই যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ। ২০১৭ সালের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ (পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ) আইনের প্রেক্ষিতে যে আচরণবিধির খসড়া আলোচিত হইতেছে, তাহাকে বিকেন্দ্রিত পরিসরে দেখা প্রয়োজন। শিক্ষকরা আদালতের দ্বারস্থ হইতে পারিবেন না, এ হেন নিয়ম গণতান্ত্রিক অধিকারের পরিপন্থী। যাঁহারা খসড়াটি রচনা করিয়াছেন, তাঁহারা সংবিধানের কথা মাথায় রাখিয়াছেন কি না, নিয়মটি চালু হইলে তাহা আদালতের ধোপে টিকিবে কি না— এই প্রশ্নগুলি যদি সরাইয়াও রাখা যায়, ঔচিত্যবোধকে মুলতুবি রাখা দুষ্কর। কোনও গণতান্ত্রিক সরকার কি নাগরিকের বিচারের অধিকারকে হরণ করিতে পারে? বিশেষত, এই আচরণবিধিতেই গণমাধ্যমে মুখ খুলিবার ক্ষেত্রেও বাধানিষেধ রহিয়াছে। অস্যার্থ, কোনও শিক্ষক গণমাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে কোনও নেতিবাচক মন্তব্য করিলে সরকার তাঁহাকে নাজেহাল করিবে। এই আচরণবিধি লইয়া স্মৃতি ইরানিরা গর্বিত হইতেন। পার্থবাবুর কথায় ততখানি গর্বের সুর নাই, এইটুকুই যাহা ভরসা।
খসড়ায় বলা হইয়াছে, শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সম্বন্ধে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ সরকারের নিকট গোপন রিপোর্ট পাঠাইবে। সরকারি কর্মীদের ক্ষেত্রে এই প্রথাটি আছে। কিন্তু, এই ক্ষেত্রেও প্রশ্নটি শেষ অবধি রাজনৈতিক প্রতিশোধের হইয়া দাঁড়াইবে, তেমন সম্ভাবনা প্রবল। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে যে অনিলায়ন ঘটিয়াছিল, তৃণমূলের আমলে তাহার প্রতাপ বাড়িয়াছে বই কমে নাই। সুতরাং, কোনও শিক্ষক যদি সরকারের রাজনৈতিক অবস্থান বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন, তবে আশঙ্কা থাকিয়া যায়, তাঁহার বিষয়ে প্রেরিত গোপন রিপোর্টটি প্রশংসামূলক হইবে না। তিনি শিক্ষক হিসাবে কেমন, নিজের দায়িত্ব পালনে কতখানি তৎপর, তাহার অধিক গুরুত্ব পাইবে তাঁহার রাজনৈতিক মতামত। ফলে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রকৃত উদ্দেশ্য মার খাইবে। দলতন্ত্রের মাহাত্ম্য দুর্মর— অতএব, শাসক-অনুরক্ত শিক্ষকরা কর্তৃপক্ষের গোপন রিপোর্টের দৌলতে লাভবান হইবেন, তেমন আশঙ্কাও থাকে। রাজনীতির বিষে রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার নাভিশ্বাস উঠিতেছে। খাঁড়ার ঘা বসাইবার প্রয়োজন আছে কি?
শিক্ষামন্ত্রী একটি প্রশ্ন করিয়াছেন— শিক্ষকদের উপস্থিতির হিসাব রাখা হইবে না কেন? আর পাঁচ জন সরকারি কর্মীকে যদি নিয়মিত অফিসে আসিতে হয়, নির্দিষ্ট সময় থাকিতে হয়, তবে শিক্ষকরাই বা ব্যতিক্রমী হইবেন কেন, এই প্রশ্নটি সম্ভবত শুধু শিক্ষামন্ত্রীর নহে। এ ক্ষণে অন্য সরকারি কর্মীদের সহিত শিক্ষকদের পার্থক্য মাথায় রাখা প্রয়োজন। শুধু প়ড়াইলেই শিক্ষকদের কাজ ফুরাইয়া যায় না। তাঁহারা নিজেরাও পড়িবেন, গবেষণা করিবেন, ইহাই প্রত্যাশিত। তাহার জন্য তাঁহাদের গ্রন্থাগারে যাইতে হইবে, ক্ষেত্রবিশেষে ফিল্ড রিসার্চ করিতে হইবে। উপস্থিতির বজ্র আঁটুনিতে তাঁহাদের বাঁধিতে চাহিলে এই কাজগুলি যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহাতে ছাত্রদের লাভ নাই, বরং ক্ষতিই। কিছু শিক্ষক এই শিথিল ব্যবস্থার অপব্যবহার করেন, অহেতুক ক্লাস ফাঁকি দেন, সে কথা অনস্বীকার্য। কিন্তু, তাঁহাদের আটকাইবার তাড়নায় শিক্ষক ও করণিকের মধ্যে ফারাকটি ভুলিয়া গেলে মুশকিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy