Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

বিজ্ঞানীর প্রতিপক্ষ

এই দাবিগুলির অভিমুখ স্পষ্ট। নরেন্দ্র মোদীর সরকার বিদ্যালয়ের শিক্ষাক্রম হইতে সরকারি মন্ত্রকের নীতি পর্যন্ত যে সকল বিচিত্র সিদ্ধান্ত লইয়াছেন, তাহাতে তাক লাগিয়া যাইতেছে দেশবাসীর।

শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

স ম্প্রতি ভারতের নানা শহরে বিজ্ঞানীরা মিছিল করিলেন। বিজ্ঞানের সাধনা নিভৃতে হইয়া থাকে, জনজীবনে তাঁহাদের সাক্ষাৎ যোগদান কম। তবু যে এতগুলি বিজ্ঞান গবেষণা সংস্থায় কর্মরত বিজ্ঞানীরা একযোগে রাস্তায় বাহির হইলেন, তাহার কারণ আপৎকালে মৌনী থাকা সম্ভব নহে। বিজ্ঞান শুধু কয়েকটি বিষয় নহে, তাহা ব্যক্তি ও জাতির জীবনের একটি ভিত্তি। তাহাকে অবলম্বন করিয়া যে জীবনযাত্রা, তাহার নির্দিষ্ট রূপ ও মান রহিয়াছে। সাক্ষ্যনির্ভরতা ও যুক্তিসিদ্ধতা যাহার প্রধান দুই স্তম্ভ। যাহা মানুষকে উৎসুকচিত্ত করিয়া তোলে, বিচারহীন সংস্কারের প্রাচীর তুলিয়া জ্ঞানের মুক্ত অঙ্গনকে বিভাজিত হইতে দেয় না। এই দৃষ্টিতে বিজ্ঞান সমাজজীবনের একটি প্রাক্শর্ত। যখন রাজনীতি তাহার শিকড় কাটিতে থাকে, বিজ্ঞানীরা বিচলিত হইবেন বইকি। তাঁহারা মিছিলে প্রস্তাব দিয়াছেন, অবৈজ্ঞানিক ধারণার প্রচার বন্ধ হউক, প্রাচীনপন্থী ধারণা ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা দূর হউক। শিক্ষা যেন কেবলমাত্র বৈজ্ঞানিক ধারণার অনুগামী হয়, এবং রাষ্ট্রের নীতি যেন সাক্ষ্য-নির্ভর বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে হয়।

এই দাবিগুলির অভিমুখ স্পষ্ট। নরেন্দ্র মোদীর সরকার বিদ্যালয়ের শিক্ষাক্রম হইতে সরকারি মন্ত্রকের নীতি পর্যন্ত যে সকল বিচিত্র সিদ্ধান্ত লইয়াছেন, তাহাতে তাক লাগিয়া যাইতেছে দেশবাসীর। কখনও জলসম্পদ মন্ত্রী সরস্বতী নদীর খাত খুঁজিতে নির্দেশ দিতেছেন, কখনও আইআইটিগুলিতে পঞ্চগব্যের গুণ খুঁজিবার কর্মশালা হইতেছে। দেশের সেরা গবেষণা সংস্থাগুলিকে বার্তা পাঠানো হইতেছে, আয়ুর্বেদের ন্যায় প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্র-নির্ভর গবেষণাই অধিক গুরুত্ব পাইবে। কখনও শিক্ষাক্রম হইতে মুঘল আমলটিই বাদ পড়িতেছে, কখনও যুদ্ধের ইতিহাস বদলাইয়া বিজয়ী হইতেছেন রানা প্রতাপ। কেহ প্রশ্ন করিতে পারেন, ইহাতে আপত্তির কী আছে? পঞ্চগব্য কিংবা সরস্বতী নদী কি গবেষণার বিষয় হইতে পারে না?

পারে বইকি, কিন্তু বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি মানিলে তাহার উপকারিতা কিংবা অস্তিত্ব বাতিল হইবার সম্ভাবনাও মানিতে হইবে। গোমূত্রের উপকার নয়, এমনকী তাহা অপকারী, এই সিদ্ধান্ত মানিতে সরকারি কর্তারা রাজি আছেন কি? গবেষকের নিরাসক্ত মতামত কোনও বিশ্বাসকে সমর্থন বা খারিজ করিবার দায় লইবে না। মনে রাখিতে হইবে, স্বাধীনতার পূর্বেই বিজ্ঞানকে সমাজ সংস্কারের এক প্রধান হাতিয়ার করিয়াছিলেন এ দেশের চিন্তানায়কেরা। ধর্মীয় আচার-রীতির ফাঁদে পড়িয়া অচল মনকে সক্রিয় করিতে তাঁহারা বিজ্ঞানের সাধনার উপদেশ দিয়াছেন। তাহা শুধু জড়জগতের প্রতি অধিক আকর্ষণের জন্য নহে। ধর্ম-সম্প্রদায়-শ্রেণি ভুলিয়া সকল মানবের প্রতি মর্যাদার যে দর্শন রহিয়াছে আধুনিক বিজ্ঞানের কেন্দ্রে, তাহাকে তাঁহারা প্রচার করিতে চাহিয়াছিলেন। অথচ আজও বিজ্ঞানের ছাত্র রোহিত ভেমুলাকে আত্মহত্যা করিতে হইতেছে, অপরাপর দলিত ছাত্ররাও বিজ্ঞানের অঙ্গন হইতে নির্বাসিত হইতেছে। মিছিলে নির্গত বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানের পঠনপাঠনের জন্য অধিক সরকারি বরাদ্দ চাহিয়াছেন। সে টাকা যদি সরকার বাস্তবিকই বরাদ্দ করে, তবে শুধু বিজ্ঞানের ছাত্র-গবেষক-শিক্ষকদের উপকার হইবে না, পুরো সমাজেরই উন্নতি হইবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Education Science Scientist
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE