Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

ক্ষতি

যেখানে বাজারের জোর আছে, সেখানে শেষ অবধি অর্থনীতিই জেতে। বামফ্রন্টের হাজার আপত্তিতেও শেষ অবধি পশ্চিমবঙ্গের কর্মক্ষেত্রে কম্পিউটারের প্রবেশ ঠেকানো যায় নাই।

শেষ আপডেট: ২২ জুলাই ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

অশান্তির মেয়াদ এখনও অবধি দেড় মাসও নহে। ক্ষতির বিস্তৃতি নিদেন পক্ষে তিন বৎসর। এই দুইটি বাক্যে দার্জিলিঙের চা শিল্পের উপর সাম্প্রতিক অশান্তির প্রভাব কতখানি, তাহা বলিয়া দেওয়া যায়। বন্‌ধের ধাক্কায় বাগান বন্ধ, ফলে চা উৎপাদনের প্রাথমিক কাজগুলিও অসমাপ্ত রহিয়াছে। বাজার অবশ্য বসিয়া নাই, তাহা নিজের ছন্দে চলিতেছে। আন্তর্জাতিক বাজারের প্রতিযোগিতায়, যথেষ্ট চাহিদা থাকা সত্ত্বেও, বাদ পড়িয়া যাইতেছে দার্জিলিং চা। বিশেষজ্ঞদের মতে, অদূর ভবিষ্যতে বর্তমান অশান্তি যদি মেটে, তথাপি চা শিল্পে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হইতে তিন বৎসর সময় লাগিবে। প্রশ্ন হইল, বিমল গুরুঙ্গ আদি নেতারা কি জানিতেন না, তাঁহাদের রাজনীতিতে চা শিল্পের উপর এমন মারাত্মক প্রভাব পড়িবে? না জানা অসম্ভব, কারণ গত দেড় মাসে তাঁহাদের নিকট একাধিক বার চা বাগানগুলিকে বন্‌ধের আওতা হইতে ছাড় দিবার অনুরোধ গিয়াছে। তাঁহারা কর্ণপাত করেন নাই। এই কথাও কি তাঁহাদের অজ্ঞাত যে পাহাড়ের কর্মসংস্থানের একটি বড় কেন্দ্র এই বাগানগুলি? সেখানকার শ্রমিকরা এমনিতেই বঞ্চিত। বাগানের অর্থনীতি ধাক্কা খাইলে সর্বাপেক্ষা ক্ষতি হইবে সেই মরিয়া থাকা শ্রমিকদেরই। না কি, গুরুঙ্গরা জানিতেন না, বহু বৎসর পর এই বার প্রকৃতি চা শিল্পের প্রতি বিশেষ রকম সদয় হইয়াছিল, বাগানগুলি ঘুরিয়া দাঁড়াইবার চেষ্টা করিতেছিল? তাঁহারা উত্তর দিবেন বলিয়া ভরসা হয় না। উত্তরের প্রয়োজনও নাই। রাজনীতির সমীকরণে সাধারণ মানুষ যে গোলাবারুদমাত্র, এই কথাটি বুঝিতে দার্জিলিং অবধি যাইতে হয় না।

সাধারণ মানুষের স্বার্থ আর রাজনীতির স্বার্থের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকা বিরল নহে। বস্তুত, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাহাই হইয়া থাকে। যেমন, শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করিতে দিলেই রাজ্যবাসীর মঙ্গল হইত, কিন্তু তাহাতে রাজনীতির অংকটি টিকিত না। অথবা, চটকলের গেটে লাল শালু না টাঙাইয়া ভিন্নতর পথে হাঁটিলে হয়তো ‘সর্বহারা’ শ্রমিকের পেটের ভাতটুকু থাকিত। এমনটাই হইয়াই থাকে। রাজনীতির দেবতার থানে সাধারণ মানুষের বলি হয় অর্থনীতির যূপকাষ্ঠে। রাজনীতির সহিত অর্থনীতির বিরোধ প্রায়শই ঘটে। অর্থনীতি নিজস্ব যুক্তিতে চলে, রাজনীতির ধার ধারিবার দায় তাহার নাই। কিন্তু, তাহার গতিপথে অলঙ্ঘ্য বাধা সৃষ্টি করিবার ক্ষমতা রাজনীতির আছে। ফলে, বিরোধ উপস্থিত হইলে রাজনীতির কারিগরদের হাতে অর্থনীতির যুক্তিটি খণ্ডিত হয়। যেমন, খুচরা ব্যবসায় বৈদেশিক পুঁজি আসিতে না দেওয়ার রাজনৈতিক জেদে মার খাইয়াছেন দেশের কৃষকরা। দেশ জুড়িয়া চলা কৃষক-বিক্ষোভগুলি বলিয়া দিতেছে, অর্থনীতির যুক্তিকে অমান্য করিলে, তাহার স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ করিলে ফল কতখানি মারাত্মক হইতে পারে। পাহাড়ের চা বাগিচায় একই নাট্য অভিনীত হইতেছে— ফারাক হইল, তাহার ব্যাপ্তি কম, কিন্তু গভীরতা অনেক বেশি।

যেখানে বাজারের জোর আছে, সেখানে শেষ অবধি অর্থনীতিই জেতে। বামফ্রন্টের হাজার আপত্তিতেও শেষ অবধি পশ্চিমবঙ্গের কর্মক্ষেত্রে কম্পিউটারের প্রবেশ ঠেকানো যায় নাই। ইন্দিরা-যুগের লাইসেন্স-রাজ শেষ অবধি সংস্কারের ঢেউয়ে ভাসিয়া গিয়াছে। আজ না হউক, পরশুর পরের দিন খুচরা ব্যবসায়েও বিদেশি পুঁজি আসিবে। কিন্তু, দার্জিলিং-এর চা বাগানগুলির পিছনে বাজারের সেই জোর নাই। আন্তর্জাতিক বাজারে দার্জিলিং চায়ের গুরুত্ব প্রচুর, কিন্তু উৎপাদনের পরিমাণে নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর। এই চায়ের জোগান না থাকিলেও আন্তর্জাতিক বাজার যথাপূর্বম্ চলিবে— পশ্চিমবঙ্গ জমি না দিলেও যেমন ভারতের শিল্প-মানচিত্রের ইতর-বিশেষ হয় না। গুরুঙ্গদের রাজনীতি, অতএব, পাহা়ড়ের অপূরণীয় ক্ষতি করিতেছে। সমতলের সমান ক্ষতি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

tea industry Darjeeling দার্জিলিং
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE