এক আলোকচিত্রী ২০০৮ সালে ইন্দোনেশিয়া গিয়া, সেই স্থানের এক দল বিপন্ন প্রজাতির বানরের সহিত ভাব জমাইয়া, ছবি তুলিতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু ক্যামেরা তাক করিলেই তাহারা ভয়ে পলায়। তখন তিনি ক্যামেরাটিতে একটি ‘প্রশস্ত দৃষ্টিপরিধি’র লেন্স লাগাইয়া, রিমোট সুইচ-এর সহিত ক্যামেরাকে যোগ করিয়া, কিঞ্চিৎ দূরে যাইলেন। বানরেরা নির্ভয়ে ক্যামেরার নিকটে আসিল, লেন্সে নিজেদের প্রতিফলন দেখিয়া বিভিন্ন মুখভঙ্গি করিতে লাগিল। একটি বানর রিমোট সুইচটি চাপিতে, বেশ কয়েকটি ছবিও উঠিয়া গেল। ফিরিয়া আসিয়া চিত্রী তাহারই মধ্যে একটি ছবিকে ‘বানর-কৃত প্রথম সেল্ফি’ বলিয়া বিক্রয় করিতে লাগিলেন। তখন জন্তুদের প্রতি সুনৈতিক ব্যবহার লইয়া চর্চাকারী এক সংগঠন বলিল, এই ছবির স্বত্ব কখনওই ওই চিত্রীর হইতে পারে না, ছবিটি তো তিনি তুলেন নাই, বানরটি তুলিয়াছে। মুশকিল হইল, আইনগত ভাবে কোনও মনুষ্যেতর প্রাণী কোনও শিল্পবস্তুর স্বত্বাধিকারী হইতে পারে না। এই বার দুই দলে তর্ক লাগিল। কেহ বলিল, মানুষটি যেহেতু ছবিটি তুলিবার আদর্শ পরিস্থিতিটি সৃষ্টি করিয়াছিলেন, তিনিই ছবিটির স্রষ্টা। বিরোধীরা বলিল, ছবি যিনি তুলেন নাই, তাঁহাকে স্রষ্টা বলা যাইতে পারে না। বানর ছবি তুলিয়াছে, অতএব ছবি হইতে প্রাপ্ত অর্থ ওই প্রজাতির বানরের উন্নয়নে ব্যয় হইবে। প্রাণী-অধিকার লইয়া ভাবিত সংগঠন বানরের তরফে মামলা করিল। তাহার নিষ্পত্তি হইয়াছে সম্প্রতি, বলা হইয়াছে ওই ছবি বাবদ ভবিষ্যতে প্রাপ্তব্য অর্থের ২৫% চিত্রী দিবেন ওই বানরের প্রজাতির উন্নয়নে।
কিন্তু প্রশ্নটি জাগিয়া থাকে। যদি জয়দেব স্নান করিতে যান, আর সেই অবসরে জয়দেবের মূর্তি ধরিয়া শ্রীকৃষ্ণ আসিয়া একটি মোক্ষম পদ লিখিয়া দিয়া যান, তবে কি ‘গীতগোবিন্দ’ বিক্রয়ের লভ্যাংশ শ্রীকৃষ্ণের মন্দির উন্নয়নের নিমিত্ত দিতে প্রকাশক বাধ্য থাকিবেন? যদি কেহ চলচ্চিত্রে জলফড়িঙের নৃত্যের দৃশ্য বহু ক্ষণ ধরিয়া দেখান, তবে ক্যামেরা চালাইয়াছেন বলিয়াই দৃশ্যের আবেদন সৃষ্টির পূর্ণ কৃতিত্ব কি তাঁহার প্রাপ্য, যেখানে ফড়িংগুলির নৃত্যের কোনও মুদ্রা, উড্ডীন হইবার মুহূর্ত, বসিয়া পড়িবার মুহূর্ত, উড়িবার দিক, গতি, কোনওটিই তাঁহার সিদ্ধান্তের আয়ত্তাধীন ছিল না? তবে কি ‘পথের পাঁচালী’র প্রাপ্ত পয়সার কিঞ্চিৎ অংশ ফড়িঙের কল্যাণে ব্যয় হইবে? বার্গম্যান তখন ‘দ্য সেভেন্থ সিল’ ছবিটি পরিচালনা করিতেছিলেন, অরণ্যে শুটিং হইতেছে, একটি চরিত্র ছটফট করিয়া মরিয়া যাইতেছে। তাহার আর্তনাদ ও শরীর-বিক্ষোভ থামিয়া যাইলেও, বার্গম্যান ‘কাট’ বলিলেন না। নিজেরও অজ্ঞাত কারণে, ক্যামেরাকে আর কয়েক মুহূর্ত চলিতে দিলেন। অকস্মাৎ মেঘ ও অরণ্যের বৃক্ষাচ্ছাদন ভেদ করিয়া, নির্দিষ্ট ওই শায়িত চরিত্রের উপরেই, সূর্যালোক আসিয়া পড়িল। আশ্চর্য সিনে-মুহূর্ত সৃষ্ট হইল। তবে কি মেঘ ও রৌদ্রকে ইহার খাজনা দান উচিত ছিল? অথবা পরিচালকের হৃদয়ে ওই আপাত-নিষ্কারণ প্রতীক্ষা-উদ্রেককারী ঈশ্বরকে? সৃষ্টি কি, স্রষ্টা কে, অত্যন্ত গুরুতর প্রশ্নাবলি। একটি উত্তর হইতে পারে: শিল্প করিবার উদ্দেশ্য লইয়া যিনি কাজটি করিতেছেন, যাঁহার মস্তিষ্কে সম্মুখবর্তী দৃশ্যের বা পঙ্ক্তিনিচয়ের সম্ভাব্য আবেদন লইয়া সচেতনতা কাজ করিতেছে, তিনিই স্রষ্টা। অচেতন-অবদানকারী স্রষ্টা নহে। চেতনার রঙেই সৃষ্টি রাঙিয়া উঠিতেছে।
নৈতিক প্রশ্নও রহিয়া যায়। এই যে বানরের কল্যাণার্থে অর্থ লওয়া হইল, ইহাতে নির্দিষ্ট বানরটির কত দূর কল্যাণ হইল? তাহার কি ভাই-বেরাদরের কল্যাণে আদৌ সম্মতি রহিয়াছে? সে হয়তো স্বজাতীয়দের ঘৃণা করে ও তাহাদের অপেক্ষা মানুষটিরই কল্যাণ চাহে? সর্বোপরি, বানরের ইজারা লইয়া কথা বলিবার দায় যাঁহারা নিজেদের স্কন্ধে লইয়াছেন, তাঁহারা কি জানেন বানরটির এহেন তর্কাতর্কিতে আদৌ মতি রহিয়াছে কি না? কোনও বিতণ্ডার কেন্দ্রে নিজেকে রাখিবার ক্ষেত্রে তাহার তীব্র অনাগ্রহ আছে কি না? সেল্ফি কে তুলিয়াছে, তাহা লইয়া যাহার সেল্ফি তাহার চাড় নাই, আর দরদি সংগঠনের ঘুম নাই, ইহা কি উদ্ভট রসের আষাঢ়ে গল্পের সমধর্মী হইতেছে না? বানর শিল্প লইয়া মাথা ঘামায় না, কারণ তাহার এহেন ‘মানুষামি’র কারবার নাই, কিন্তু মানুষ অবান্তর বিষয় লইয়া বৎসরের পর বৎসর নিজেকে ও অন্যকে ঘোল খাওয়াইয়া ছাড়ে, ইহাতে হয়তো মানুষের ‘বানরামি’ই প্রকট হয়। যাউক, মনুষ্যজাতির একটি ‘সেল্ফি’ তো এই মামলা-কাণ্ডে স্পষ্ট পরিস্ফুট হইল!
যৎকিঞ্চিৎ
সহবাগ বললেন, উনি ভারতীয় দলের কোচ হতে পারেননি, কারণ কোচ-বাছিয়েদের সঙ্গে ওঁর ‘সেটিং’ ছিল না। এ বার ওঁকে সাম্মানিক বাঙালি ডিগ্রি দেওয়া যাবে, কারণ এই থিমে বাঙালি ঝনঝন ২৪x৭। কবি বলছে ওই কবি প্রাইজ পেয়েছে সেটিং করে, মা বলছে ওই ওর ছেলে বড় স্কুলে ঢুকে গেল সেটিং করে, সরকার বলছে অন্য সব রাজ্য বাংলাকে মেরে বেরিয়ে গেল কেন্দ্রের সঙ্গে সেটিং করে। সেটিং-নালিশ আছে বলেই বাঙালির এত গর্জন, বাঘ না হোক, সে বিলক্ষণ সহ-বাঘ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy