বি জ্ঞানের জন্য মানুষ রাস্তায় নামিলেন। এ দৃশ্য বিরল। বিজ্ঞানচর্চা নিভৃতে হইয়া থাকে। বিজ্ঞানীও সাধারণ মানুষের ধারণায় এক রহস্যময়, দুর্বোধ্য চরিত্র। তবু যে বসুন্ধরা দিবসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ বিশ্বের নানা দেশে বিপুল সংখ্যায় মানুষ মিছিল করিলেন, তাহা বুঝাইল যে, বিজ্ঞানের সহিত জনজীবনের সম্পর্কটি মানুষ বিস্মৃত হয় নাই। যুক্তি সাক্ষ্য ও প্রমাণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে অভ্যাসটি বিজ্ঞান তৈরি করে তাহাই আধুনিক সমাজের ভিত্তি। তাহাকে স্থানচ্যুত করিয়া সেখানে কোনও এক প্রাক্সিদ্ধ, প্রশ্নাতীত প্রত্যয়কে বসানোর অর্থ, বহুকষ্টার্জিত মুক্ত চিন্তা, বুদ্ধির চর্চার ধারাটিকে অস্বীকার করা। বিজ্ঞানের যুক্তি-প্রমাণকে অগ্রাহ্য করিবার যে ঔদ্ধত্য রাষ্ট্রপ্রধানরা দেখাইতেছেন, বাইশে এপ্রিল তাহারই প্রতিবাদ করিলেন মানুষ। ইহার শুরু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিষেকে। সে দেশের পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থার ওয়েবসাইট হইতে আবহাওয়ার পরিবর্তন, বিশেষত উষ্ণায়ন সম্পর্কে সমস্ত তথ্য মুছিয়া দিতে বলা হইয়াছে। এ সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমে কোনও তথ্য জানাইতে নিষেধ করা হইয়াছে। এই বিষয়ে তথ্যও দুর্লভ করিয়া তোলা হইতেছে। মার্কিন সরকারের এই সকল সিদ্ধান্ত দাঁড়াইয়া আছে এই বিশ্বাসের উপর যে বিশ্ব উষ্ণায়ন বলিয়া কিছু নাই। কোনও বৈজ্ঞানিক সাক্ষ্যপ্রমাণ দ্বারা তাহাতে আঘাত করা সম্ভব হইবে না। তাহা প্রশ্নাতীত বিশ্বাস।
ভারতে তাহারই প্রতিচ্ছবি দেখিতেছেন নাগরিকরা। এ বৎসর বাজেটে মহাকাশ বিজ্ঞানে গবেষণার জন্য অনুদান একুশ শতাংশ বাড়িলেও ভূবিজ্ঞান মন্ত্রক, যাহা আবহাওয়া পরিবর্তনের গবেষণার দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাহার অনুদান বাড়িয়াছে তিন শতাংশেরও কম। ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে দাঁড়াইয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দাবি করিয়াছেন, প্রাচীন ভারতীয়রা প্লাস্টিক সার্জারি হইতে নলজাতকের উৎপাদন, সকল কৌশল জানিতেন। জলসম্পদ মন্ত্রী উমা ভারতী জাতীয় জলবিজ্ঞান সংস্থাকে নির্দেশ দিয়াছেন, গঙ্গার উৎস যে গোমুখ নহে, তাহা খুঁজিয়া বাহির করিতে। পঞ্চগব্যের উপকারিতার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি খুঁজিতে সভা করিয়াছে দিল্লির আইআইটি।
ইহা শুধু বিজ্ঞানের পক্ষে নহে, গণতন্ত্রের পক্ষে এক অশনিসংকেত। ইতালীয় লেখক উমবের্তো একো লিখিয়াছিলেন, ফ্যাসিবাদের প্রথম লক্ষণ ঐতিহ্যবাদ, যাহা নূতন জ্ঞানে বিশ্বাস করে না। মানবসভ্যতার আদিযুগেই সত্য কোনও এক আশ্চর্য (সাধারণত অতিপ্রাকৃত) উপায়ে উদ্ঘাটিত হইয়া গিয়াছে। তাহার নড়চড় নাই, পরিবর্তন তো অসম্ভব। প্রতি যুগে সেই প্রাচীন সত্যকে আরও একটু স্পষ্ট, বোধগম্য করিতে হইবে কেবল। বিজ্ঞানের অবস্থান ইহার ঠিক উল্টো দিকে। যাহা প্রত্যক্ষসিদ্ধ জ্ঞান, যাহা পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ দ্বারা সিদ্ধ, এবং যাহার খণ্ডন অসম্ভব নহে, তাহাকেই বৈজ্ঞানিকরা ‘জ্ঞান’ বিবেচনা করেন। যুক্তি দিয়া বিরুদ্ধ মতকে বুঝিবার যে অভ্যাস বিজ্ঞান তৈরি করিয়া দেয়, তাহাই পরস্পরের মতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহিষ্ণুতার ভিত্তি। গণতন্ত্রেরও। দুই বৎসর পূর্বে এ দেশের একশো জন বিজ্ঞানী প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখিয়া অসহিষ্ণুতার পরিবেশের প্রতিবাদ করিয়াছিলেন। এই বিপন্নতা শুধু ভারতের নহে, শুধু মার্কিনিদেরও নহে। বিশ্ব জুড়িয়া তাহার প্রকাশ দেখা গেল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy