সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা চালু হইল কৃষ্ণনগরে। নদিয়ায় আরও কয়েকটি স্কুল ইংরেজি মাধ্যম হইবার অনুমোদন পাইয়াছে। অন্যান্য জেলা হইতেও আবেদন আসিতেছে। যেন বৃত্ত সম্পূর্ণ হইতেছে। আশির দশকের গোড়ায় বামফ্রন্ট সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয় হইতে ইংরেজি বর্জন, এবং ইংরেজি মাধ্যম স্কুল তুলিয়া দিবার সিদ্ধান্ত লইয়াছিল। এ বার রাজ্য ফের ফিরিতেছে ইংরেজিতে। ক্ষমতায় আসিবার ছয় বৎসর পর কংগ্রেস আমলে গঠিত হিমাংশুবিমল মজুমদার কমিটির মন্তব্য ‘প্রাথমিক স্কুলে দুটি ভাষা পড়াইলে ছাত্রদের উপর চাপ সৃষ্টি হয়’ উদ্ধৃত করিয়া ‘ইংরেজি হঠাও’ অভিযানে মাতে বাম সরকার। ফলাফল, সর্বভারতীয় পরীক্ষাগুলিতে এ রাজ্যের পড়ুয়াদের মন্দ ফল, কর্মক্ষেত্রে তাহাদের ইংরেজিতে দুর্বলতার কারণে পিছাইয়া যাওয়া। সর্বোপরি, স্কুলশিক্ষার একটি উদ্দেশ্য সব শিশুর মধ্যে সমান দক্ষতা তৈরি করিয়া সমাজে আর্থ-সামাজিক সাম্য আনিবার চেষ্টা। ইংরেজি-বর্জন তাহার বিপরীতে লইয়া গিয়াছে রাজ্যকে। বিত্তবান পরিবারগুলি সন্তানদের পাঠাইয়াছে বেসরকারি, ইংরেজি-মাধ্যম স্কুলে। দরিদ্র পরিবারগুলি পাঠাইয়াছে বাংলা-মাধ্যম সরকারি স্কুলে। বিদ্যালয়ও আর্থ-সামাজিক বিভাজনের প্রতীক হইয়া উঠিয়াছে। ‘বেঙ্গলি মিডিয়াম’ ছাপটি ক্রমশ পড়ুয়াদের সংকুচিত, লজ্জিত করিয়াছে।
বৃহত্তম ক্ষতি হইয়াছে বাংলা ভাষার। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলিতে বাংলা প্রায়ই ‘দ্বিতীয় ভাষা’ হিসাবে থাকে। তাহার পঠনপাঠনে যথেষ্ট আগ্রহ বা পারদর্শিতা নাই স্কুলগুলির। ফলে বাংলা ভাষাটিই উপেক্ষা, অবহেলার বস্তু হইয়া দাঁড়াইয়াছে। শহরের বর্তমান প্রজন্ম বাংলা গদ্য-পদ্য ইংরেজি অনুবাদে পড়িতেই এখন অভ্যস্ত। বামফ্রন্ট সরকারই অবশ্য জনমতের চাপ টের পাইয়া চাকা ঘুরাইয়াছিল। ১৯৯১ সালে পবিত্র সরকার কমিটি ফের প্রাথমিকে ইংরেজি ফিরাইবার বিধান দেয়। তাহার পর সরকার ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের বিরুদ্ধে নীতিগত আপত্তিও প্রত্যাহার করিয়া নেয়। কিন্তু প্রথম শ্রেণি হইতে ইংরেজি চালু হইলেও সরকারি স্কুলগুলিতে ইংরেজি মাধ্যম চালু হইবার খুব বেশি উদ্যোগ দেখা যায় নাই। যথেষ্ট ইংরেজি পারদর্শী শিক্ষকের অভাব তাহার কারণ হইতে পারে, ইংরাজিতে সকল বিষয়ের পাঠ্যবই সুলভ না হওয়াও একটি সমস্যা হইতে পারে। একই সঙ্গে, শহরগুলিতে দ্রুত হারে বেসরকারি স্কুলের প্রতিষ্ঠা, পশ্চিমবঙ্গের মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠক্রমের চাইতে কেন্দ্রীয় শিক্ষা পর্ষদগুলির পাঠক্রমের উৎকর্ষ, এগুলি কলকাতা ও বড় জেলা শহরগুলির মধ্যবিত্তদের সরকারি স্কুলের প্রতি বিমুখ করিয়াছে।
আজ সেই পর্বের পুনরাভিনয় হইতেছে জেলাগুলিতে। গ্রামে গ্রামে বেসরকারি স্কুল গজাইয়াছে, যাহাদের প্রধান আকর্ষণ ইংরেজি শিক্ষা। সরকারি স্কুলে নাম লিখাইয়া ছাত্ররা সেই সকল স্কুলে যাইতেছে। সরকারি স্কুলগুলিতে ছাত্রের সংখ্যা কমিতেছে। এখন শিক্ষার অধিকার আইন বলবৎ হইয়াছে, কেন্দ্রের তরফে ক্লাসে পড়ুয়াদের উপস্থিতি লইয়া, স্কুলছুটের হিসাব লইয়া কড়াকড়ি চলিতেছে, ফলে ফাঁপরে পড়িতেছেন স্কুলকর্তারা। ইংরেজিকে তামাদি করিয়া, এখন নিজেরা তামাদি হইবার ভয়ে তাঁহারা ফের ইংরেজির শরণ লইতেছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy