আমেরিকার রাষ্ট্রপতির ঘোষিত অভিবাসন নীতি নিয়ে নতুন করে বিস্মিত হওয়ার কারণ নেই। নির্বাচনী প্রচারের সময়েই ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেন যে, আমেরিকা আমেরিকাবাসীদের জন্য এবং আমেরিকার কাজ উনি আমেরিকাতে ফিরিয়ে আনবেন। মেক্সিকোর সীমানায় পাঁচিল তোলা থেকে কারিগরি শিক্ষায় দক্ষ কর্মীদের ভিসা আটকে দেওয়ার পরিকল্পনা এই ঘোষণার রূপায়ণ, তা বোঝা সহজ। এর অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য এবং উপকারিতা বোঝা ততটা সহজ নয়। অতি-দক্ষিণপন্থী অর্থনৈতিক দর্শনও বলবে, দক্ষ আর মাঝারি দক্ষ কর্মীরা যদি কম কর্মীসংখ্যার মূলধন-নির্ভর দেশে আসেন, তা হলে দেশের জাতীয় আয় বাড়ে। অনেক কর্মী এলে সেখানে মাইনের হার কমে, ব্যবসায়ীর মুনাফা বাড়ে, উৎপাদন বাড়তে পারে এবং আরও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। উলটো দিকে, দেশ থেকে পুঁজি বেরিয়ে গেলে, দেশে সুদের হার বেড়ে গিয়ে বিনিয়োগ কমে যেতে পারে, জাতীয় আয় ধাক্কা খেতে পারে। ব্যবসায়ী কোটিপতি ট্রাম্প মুনাফা বাড়ার কথা ভাবেন না, তা-ও হয় নাকি?
আমেরিকাতে কর্মীদের মাইনে অনেক বেশি বলেই তো ‘আউটসোর্সিং’ বা বিদেশের মাটিতে উৎপাদন করার ঢালাও প্রক্রিয়া চালু করেছেন সে দেশের ব্যবসায়ীরা। অভিবাসীদের দেশে ঢোকা বন্ধ, আবার আমেরিকার চাকরি বিদেশে পাঠানোও বন্ধ, এই দুটো একসঙ্গে ঘটলে ব্যবসায়ীরা খুশি হবেন কি? ট্রাম্প হয়তো নির্বাচনের খরচ নিজেই বহন করতে পারেন, ফলে ব্যবসায়ীরা রেগে গিয়ে যদি তাঁর পরের নির্বাচনে টাকা না ঢালেন, তাতে তাঁর ভয় নেই। কিন্তু, সে দেশের ব্যবসায়ীরা আগের মতো মুনাফা করতে চাইলে, ‘সামথিং গট টু গিভ’; অর্থাৎ এই দড়ি টানাটানির খেলায় কোনও একটা বাঁধন ছিঁড়বেই।
আমেরিকার ব্যবসা গুটিয়ে চিন-ভিয়েতনামে ব্যবসা করার রাস্তা অনেক দিন আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত। ভারত ও চিনে পরিষেবা আর উৎপাদনের এই বিপুল সাম্রাজ্য আমেরিকার মায়েদের চিন্তায় ফেলে। তাঁরা নাকি বাচ্চাদের তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে তুলে অঙ্ক করাতে বসান; পড়াশোনায় ভাল না হলে তাদের চাকরি নাকি ভারতীয় আর চিনেরা নিয়ে নেবে। এই ভয়ের তাড়নাতেও যদি আমেরিকার মানবসম্পদ উন্নত হয়ে থাকে, মন্দ কী? কিন্তু নতুন অভিবাসন নীতির দৌলতে সেটাও সম্ভবত হবে না। চাকরি পাওয়া যদি নিশ্চিত হয়ে যায়, তা হলে আর ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি উঠে অঙ্ক করার কী দরকার? অভিবাসীদের কিন্তু দক্ষতা প্রমাণ করে চাকরি পেতে হয়। আমেরিকার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে জলপানি পেয়ে পড়তে যাওয়াও তাই— হাজার হাজার আবেদনপত্রের মধ্যে থেকে যখন কোনও বিশ্ববিদ্যালয় একটি ভারতীয় ছাত্র বা ছাত্রীকে বেছে নেয়, সেটা যোগ্যতারই পরিমাপ, দয়া-দাক্ষিণ্যের নয়। চিন, ভারত, তুরস্কের ছেলে-মেয়েরা এই নতুন অভিবাসন নীতির ফলে আটকে যেতে পারে, কিন্তু সে ক্ষেত্রে আমেরিকার বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর ও পিএইচ ডি কোর্সে আসন না ভরার সম্ভাবনা বিপুল। কারণ, আমেরিকার বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা না করেও দিব্যি মার্সিডিজ গাড়ি চড়ে ঘুরতে পারে। অন্য দিকে, চিন-ভারতের বাবা-মায়েরা দীর্ঘ দিন ধরে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে টিউশন থেকে টিউশনে দৌড়েছেন। আশা, পরীক্ষায় দারুণ ফল করে চাকরি নিয়ে সন্তান আমেরিকাবাসী হবে। প্রায় একই চাকরিতে, দুটি দেশের দামের পার্থক্য বিচার করেও, আমেরিকাতে রোজগার হবে প্রায় দশ গুণ; ক্ষেত্রবিশেষে একশো গুণ।
আমেরিকাবাসী কর্মী তার থেকে সামান্য কিছু পাঠালেই দেশে থাকা আত্মীয়-স্বজনের জীবনযাত্রার মান বেড়ে যায় অনেকখানি। ফলে অভিবাসী হতে চাওয়ার চাহিদা কমবে না সহজে। এ দিকে, ভিসার জোগান কমলে যেতে বাধা আসবে। এর ফলে দেশের মধ্যে মানবসম্পদ উন্নত হতেও পারে। আজকাল, দিল্লি-মুম্বইয়ের জীবনযাত্রা আমেরিকাকে স্মরণ করায় অবিরত। উৎপাদনশীলতা বাড়লে ভারতেও রোজগার বাড়বে আর তা খরচ করার জন্য আমেরিকাজাত পণ্য রয়েছে। অদক্ষ শ্রমিকের জন্যও পশ্চিম এশিয়ার চাকরি রয়েছে, একান্ত যুদ্ধ না বাধলে চাকরির নিশ্চয়তাও রয়েছে।
আমেরিকায় দক্ষ এবং অদক্ষ শ্রমিকের রোজগারে বৈষম্য বাড়ায় সামাজিক টেনশন বেড়েছে। সেই অপ্রাপ্তি ব্যবহার করেই এই নতুন রাজনৈতিক অবস্থান। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবিদ্বেষের চরম অবস্থায় সাদাদের জন্য বড় চাকরি আটকে রাখার ব্যবস্থা ছিল, সে অদক্ষ হলেও; একান্ত না করতে চাইলে অন্যরা সুযোগ পেত। বর্ণবৈষম্যের আর্থিক কুফল দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবোয়ে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। ব্যবসা করতে চাইলে অনিচ্ছুক ফাঁকিবাজ কর্মী চাইবেন, নাকি পরিশ্রমী কর্মী? এটি শ্রমবাজারের সহজ শর্ত। এ রকম বহু অর্থনৈতিক শর্ত লঙ্ঘন করে ট্রাম্পের গা-জোয়ারি নীতি দীর্ঘমেয়াদে বহাল রাখা শক্ত।
আর, আমেরিকার বহু মানুষ কিন্তু মন থেকে বর্ণবিদ্বেষী নন। কারণ, ‘দ্য নিউ ওয়ার্ল্ড’-এ কে অভিবাসী নয়?
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy