ভারতে জনসমাজে প্রশাসন সম্পর্কে যতই নিন্দামন্দ চলুক, সাধারণ মানুষের ‘আস্তিকতা’ রহিয়াছে: অপরাধ যত জটিল হউক, পুলিশ চেষ্টা করিলে রহস্য ভেদ হইবেই। সাত বৎসরের শিশুকে স্কুলের শৌচালয়ে গলা কাটিয়া হত্যার ঘটনা দেশকে কাঁপাইয়া দেয়, কিন্তু হত্যাকারী মাত্র সাত ঘণ্টার মধ্যে চিহ্নিত হইয়াছে জানিয়া, গৃহস্থ কিছুটা হইলেও স্বস্তির শ্বাস ফেলেন। স্কুলের বাস-কন্ডাক্টর বাসে থাকা একটি ছুরি ধুইতে শৌচালয়ে ঢুকিয়াছিল, শিশুটিকে দেখিয়া যৌন নিগ্রহ করিতে গিয়াছিল, বাধা পাইয়া হত্যা করে— পুলিশের নিকট হইতে ইহা জানিয়া জনগণ আলোচনা করিতে থাকেন, স্কুলের শৌচালয়ে কর্মীদের ঢুকিবার অধিকার লইয়া। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই পুলিশের হাত হইতে ভার লইয়া সিবিআই তদন্ত করিয়া বলিতেছে, হত্যাকারী একাদশ শ্রেণির এক ছাত্র। তাহা হইলে পুলিশ কী করিয়া কন্ডাক্টরকে গ্রেফতার করিল, সর্বসমক্ষে তাহাকে এই অপরাধে অভিযুক্ত করিল? তবে কি সমগ্র দেশ জুড়িয়া আলোড়ন, এবং হয়তো সরকারি স্তর হইতে দ্রুত অপরাধী খুঁজিয়া বাহির করিবার চাপ মিলিয়া পুলিশকে তড়িঘড়ি একটি বলির পাঁঠা দাঁড় করাইবার দিকে ঠেলিয়া দিল? শিশুটির দেহের ময়না তদন্তে কোনও যৌন নিগ্রহের চিহ্ন পাওয়া যায় নাই। স্কুলবাসের ড্রাইভার বলিয়াছে, বাসে ছুরি ছিল না। কন্ডাক্টরকে বাথরুমে ঢুকিতে দেখিয়াছিল যে উদ্যানকর্মী, সে বলিয়াছে তাহার হাতে ছুরি দেখে নাই। পুলিশ কি এই তথ্যগুলি জানিত না, না কি জানিয়াও মূল্য দেয় নাই, না প্রকৃত তথ্য আড়াল করিয়াছে? কন্ডাক্টরের পরিবার বলিতেছে, তাহাকে মাদক সেবন করাইয়া ভুল স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করা হইয়াছে। তদন্ত শেষ হয় নাই, এখনও সকল কথা নিঃসংশয় ভাবে জানা যায় নাই, কিন্তু ঘটনার নৃশংসতার সহিত মিশিয়া গিয়াছে পুলিশি তদন্তপ্রক্রিয়ার অস্বচ্ছতা ও সম্ভাব্য মিথ্যাচার।
ন্যায়বিচার ও তাহার সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্যে সর্বাগ্রে নিহিত এই কথা: শত অপরাধী যদি বা ধরা না পড়ে, এক জন নিরপরাধকেও শাস্তি দেওয়া চলিবে না। পুলিশ যদি এক নিরপরাধকে জোর করিয়া অপরাধী সাজায়, তাহার অধিক ন্যক্কারজনক অপরাধ কিছু হয় না। যে পুলিশ দ্রুত অপরাধী খুঁজিয়া দিবার ফলে প্রশাসনের প্রতি জনতার আস্থা মজবুত হইয়াছিল, সেই পুলিশই যদি বাস্তবে এই স্তরের কপটাচরণ করিয়া থাকে, তাহা শুধু গুরুগ্রাম পুলিশের নহে, সমগ্র দেশের পক্ষে লজ্জার। কারণ অপদার্থতা খুবই খারাপ, কিন্তু অপদার্থতা ঢাকিতে অন্য মানুষের সর্বনাশ করিলে, তাহা অধিক গর্হিত, আর সেই কার্য যদি এমন কারও দ্বারা সম্পাদিত হয় যে ন্যায়প্রতিষ্ঠার কারবারি, তাহার অধিক ভ্রষ্টাচার কিছুই নহে। পুলিশকে তদন্তের প্রতিটি মুহূর্তে মনে রাখিতে হয়, প্রতিটি সন্দেহভাজনেরও মানবাধিকার রহিয়াছে। মনে রাখিতে হয়, অভিযোগ করিবার পরে অভিযুক্তের উপর যে সামাজিক কলঙ্কের ছাপ্পা লাগিয়া যায়, তাহা তাহার ভবিষ্যৎকে অন্ধকার করিয়া দিতে পারে, এমনকী পরে সে নিরপরাধ প্রমাণিত হইলেও। আর যদি সে নিরপরাধ হইয়াও শাস্তি পায়, তাহাতে তাহার ও পরিবারের সর্বনাশ তো সাধিত হয়ই, তদুপরি বিচারব্যবস্থাকে সচেতন ভাবে ঠকানো হয়। সকল কথা জানিয়া বুঝিয়া, সুনীতি ও ঔচিত্যের বিরুদ্ধে গিয়া, সংগঠিত ভাবে পরিকল্পনা করিয়া, সারা দেশকে যদি কোনও পুলিশবাহিনী ঠকাইয়া থাকে, এবং যদি ভাবিয়া থাকে এক দরিদ্র ও সমাজের তথাকথিত নিচু শ্রেণির সদস্যের গাত্রে যৌন নিগ্রহকারী ও হত্যাকারীর তকমা লাগাইলে তাহা সহজেই বিশ্বাসযোগ্য হইবে, তবে সেই প্রকল্পের কথা ভাবিয়া এই দেশের নাগরিকের মাথা লজ্জায় হেঁট হইয়া যাওয়া উচিত। এবং এই ন্যায়ের ধ্বজাধারী অপরাধীদের প্রতি অকৃত্রিম ঘৃণা লালন করা উচিত। কারণ মানুষের বিশ্বাসও শিশুর ন্যায় পবিত্র। তাহাকে গলা কাটিয়া খুন করিবার অধিকার কাহারও নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy