Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

সামন্ততন্ত্রের মেরুদণ্ডের সঙ্গে ভেঙেছিল ব্যক্তিসত্তাও

বলশেভিক বিপ্লবের শতবর্ষে ইতিহাসবিদ হরি বাসুদেবনযখনই একটি বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠী তুমুল সংঘাত ছাড়াই অন্য একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে ক্ষমতাচ্যুত করে, তখনই এই ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়াটিকে আমরা ক্যু বলে থাকি।

প্রস্তুত: দশ লক্ষেরও বেশি মানুষ সমবেত হয়ে জানালেন, তাঁরা বিপ্লবের পক্ষে। পেট্রোগ্রাড, ৭ নভেম্বর, ১৯১৭। ছবি:গেটি ইমেজেস

প্রস্তুত: দশ লক্ষেরও বেশি মানুষ সমবেত হয়ে জানালেন, তাঁরা বিপ্লবের পক্ষে। পেট্রোগ্রাড, ৭ নভেম্বর, ১৯১৭। ছবি:গেটি ইমেজেস

শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

প্রশ্ন: এখনও অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, ৭ নভেম্বর ১৯১৭ সালে, পেট্রোগ্রাডে যা ঘটেছিল তা একটি ক্যু, অর্থাৎ অভ্যুত্থান, তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। আপনি কি এই মূল্যায়নের সমর্থক?

হরি বাসুদেবন: যখনই একটি বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠী তুমুল সংঘাত ছাড়াই অন্য একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে ক্ষমতাচ্যুত করে, তখনই এই ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়াটিকে আমরা ক্যু বলে থাকি। কিন্তু সেই দিনে রাশিয়াতে আরও অনেক কিছু ঘটেছিল, যা নিঃসন্দেহে ক্যু-এর অধিক। এক, শুধু পেট্রোগ্রাডে নয়, সেই দিন মস্কো এবং রাশিয়ার অন্যান্য বহু শহরে এই ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। আঞ্চলিক সোভিয়েট কমিটিগুলি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিনিধিদের কোণঠাসা করে এবং আঞ্চলিক প্রশাসনের ভার নিজেদের হাতে তুলে নেয়। বিভিন্ন অঞ্চলে সক্রিয় বলশেভিক প্রশাসকরা নিজেদের ভিতর সমন্বয়ের গুরুত্বপূর্ণ কাজও সম্পন্ন করে। দুই, ৮ নভেম্বরই পেট্রোগ্রাডেই দেশের সব ক’টি সোভিয়েট কমিটি এক বিরাট সম্মেলনে মিলিত হয়। এই সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী সব প্রতিনিধি দেশ জুড়ে বলশেভিক সোভিয়েটের কার্যক্রমের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে। এই সর্বাত্মক প্রক্রিয়াটিকে স্মরণে রেখেই অনেক ইতিহাসবিদ বলেছেন, যা ঘটেছিল, তা হল একটি বিরাট অভ্যুত্থান।

প্র: ক্ষমতা দখলের পর নতুন সোভিয়েট শাসকরা জনসাধারণের সার্বিক স্বার্থ মনে রেখে কী কী পদক্ষেপ করেছিলেন?

উ: পদক্ষেপগুলিকে প্রথম ও দ্বিতীয় কারণের সঙ্গে সংযুক্ত করে বলতে পারি, এক কথায়, সর্বাত্মক বিপ্লব রাশিয়াকে উজ্জীবিত করেছিল। আমার মনে হয়, জটিল প্রক্রিয়াটি এ বার সহজবোধ্য হয়েছে—প্রথমে ক্যু, তার পর অভ্যুত্থান এবং সবশেষে সর্বাত্মক বিপ্লব। এ বারে আসা যাক বলশেভিকদের প্রণীত প্রশাসনিক এবং আদর্শগত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে। প্রথমত, লেনিন ও তাঁর সহযোগীরা দেশটিকে ধর্মনিরপেক্ষ করে তুলবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা করেন। রুশ অর্থডক্স চার্চের ডানা ছাঁটা হয়, প্রভাব ও প্রতিপত্তি কমিয়ে আনা হয়, এমনকী চার্চটির বিস্তীর্ণ ভূসম্পত্তির কিছুটা বাজেয়াপ্তও করা হয়। এই ধর্মনিরপেক্ষতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আইন-নির্ভর বিবাহের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। দ্বিতীয়ত, ১৯১৭ সালের ডিসেম্বর মাস থেকেই বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের স্বার্থরক্ষার জন্য সামন্ততান্ত্রিক রেন্ট ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হয়। যে ফরমান এ ক্ষেত্রে জারি করা হয়, তা নিঃসন্দেহে বৈপ্লবিক; কৃষকদের বলা হয়, যে জমি আপনারা চাষ করছেন, তার মালিকও আপনারা। অর্থাৎ এক কথায়, লাঙল যার, জমি তার।

তৃতীয়ত, দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকের কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সুতরাং আমরা দেখছি, একটা দ্বিমুখী অভিযান চালু করা হয়েছিল। এক দিকে, গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের জমিপ্রদান, অন্য দিকে শহরে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রণ। চতুর্থত, যে আঞ্চলিক সোভিয়েটগুলি স্থানীয় কলকারখানার মালিকানা হাতে নিয়েছিল, তাদের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানানো হয়েছিল। জাতীয়করণের বিরাট সূচনা এখান থেকেই। লক্ষণীয়, মাত্র দেড় মাসের মধ্যে গ্রামে-শহরে এই ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত করা হয়। এগুলিকে স্মরণে রেখেই আমরা অনায়াসে দাবি করতে পারি, রাশিয়ায় সর্বাত্মক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল, ৭ নভেম্বর পেট্রোগ্রাড দখলে যার সূচনা।

প্র: সোভিয়েটদের বিরুদ্ধে বলা হয়, তারা নাকি ভিন্নমতাবলম্বীদের উপর নিপীড়ন চালিয়েছিল, বিশেষ করে লেনিনকে হত্যার প্রচেষ্টার পর। খোদ রোজা লুক্সেমবুর্গই উচ্চ কণ্ঠে এই অভিযোগ করে বলেছিলেন, ‘লেনিন ভেবেছেটা কী?’

উ: ক্ষমতা দখলের পর বলশেভিকরা মৃত্যুদণ্ড রদ করে। কিন্তু এই অবস্থান থেকে তারা সরে আসতে বাধ্য হয় যখন স্বয়ং লেনিনকেই বিরুদ্ধবাদীরা হত্যা করার চেষ্টা চালায়। বলশেভিকরা তখন বলেছিল, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড চালু থাকবে। মনে রাখতে হবে, ১৯১৮ থেকেই, অর্থাৎ পেট্রোগ্রাড অভ্যুত্থানের কয়েক মাস পর থেকেই রাশিয়ায় শুরু হয় রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ। এক দিকে লাল সন্ত্রাস, অন্য দিকে শ্বেত সন্ত্রাস। লিয়ন ট্রটস্কি তখন তাঁর বিশেষ ট্রেনে চেপে চারিদিকে ছু়টে বেড়াচ্ছেন বিপ্লব-বিরোধীদের দমনের লক্ষ্যে (ট্রটস্কি ছিলেন রেড আর্মির সর্বাধিনায়ক) আর স্তালিন সোভিয়েট সংবাদমাধ্যম প্রাভদা-য় ছেপে চলেছেন একটির পর একটি প্রতিবেদন ও নিবন্ধ। শ্বেত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে।

রোজা লুক্সেমবুর্গ তীব্র সমালোচনা করেছিলেন, ঠিকই। কিন্তু তাঁকে তো সোভিয়েট ইউনিয়নের প্রকৃত, অশান্ত পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়নি। তবে একটা কথা ঠিক, রাশিয়ার কমিউনিস্টরা খুবই অনিচ্ছা সহকারে মৃত্যুদণ্ড চালু রেখেছিলেন। এবং রোজা লুক্সেমবুর্গ তাঁর সমালোচনাকে চূড়ান্ত বলে অভিহিত করেননি। লেনিন ও ট্রটস্কির প্রতি ছিল তাঁর অবিচল শ্রদ্ধা। জার্মানিতে কৃষক-শ্রমিকদের সমাবেশে তিনি বারংবার বলেছিলেন, রাশিয়ার বিপ্লব এক যুগান্তকারী ঘটনা। কয়েকটি ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু যে সর্বাত্মক পরিবর্তন বলশেভিকরা করেন, তাকে তিনি বহু বার কুর্নিশ করেছিলেন। কৃষকেরা জমি পেয়েছিল, সামন্ততন্ত্রের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা শহরে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে এনেছিলেন। বিরাট দেশ জুড়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের প্রসার ঘটিয়েছিলেন। তাঁর উদ্দীপক ভাষণগুলিতে রোজা এই বিষয়গুলি উল্লেখ করতে কখনও ভোলেননি।

প্র: রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়নেও সমালোচনা ও প্রশস্তি— দুইই স্থান পেয়েছিল।

উ: রবীন্দ্রনাথ সোভিয়েট ইউনিয়নে যান ১৯৩০ সালে। তখন দেশ জুড়ে চলেছে সমগ্রীকরণের প্রক্রিয়া। সেই বিরাট, ব্যাপক, বিস্তৃত কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের প্রভূত উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা দেখে রবীন্দ্রনাথ অভিভূত হন। কিন্তু ‘রাশিয়ার চিঠি’-র সমাপ্তি অংশে তিনি লেখেন, জনসাধারণকে কেন্দ্র করে বিপুল সার্বিক উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু এই কর্মযজ্ঞে ব্যক্তিমানুষের স্বপ্ন, অভিলাষ, নিজস্বতা যেন তার পথ খুঁজে পাচ্ছে না। যা কিছুটা বিস্ময়কর, তা হল, সোভিয়েট ইউনিয়নের সৃষ্টিকর্ম বিষয়ে তিনি সে রকম কিছু লেখেননি। সেই উত্তাল সময়ে অসিপ ম্যান্ডেলস্টাম-এর মতো কবি, বুলগাকভ-এর মতো কথাশিল্পী রাশিয়াতেই তাঁদের সৃষ্টি অব্যাহত রেখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এঁদের সঙ্গে মিলিত হলে আমরা বেশ কয়েকটি হৃদয়ী সংলাপ হাতে পেতাম। তবে সোভিয়েট ইউনিয়নের অগ্রযাত্রাই ‘রাশিয়ার চিঠি’র বৃহদংশ জুড়ে। এই অগ্রযাত্রার সঙ্গেই দেশের দুরবস্থার তুলনা করে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন, বেদনাবিদ্ধ হয়েছিলেন।

প্র: সমগ্রীকরণের জনক ও প্রণেতা জোসেফ স্তালিন কি লেনিনের বিপ্লবের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন? ‘গ্রেট পার্জ’ মনে রেখে এ প্রশ্ন করছি।

উ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নায়ক জোসেফ স্তালিনকে আমি বিশ্বাসঘাতক বলব না। তবে গ্রেট পার্জ পর্বে (১৯৩৬-৩৮) তিনি হন্তারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ যে আশঙ্কা করেছিলেন— ব্যক্তিগত অভিলাষ এবং স্বপ্ন কর্তিত হচ্ছে— স্তালিন তা-ই করেছিলেন। সেই ব্যক্তিগত, নিজস্ব কণ্ঠকেই তিনি দমন করেছিলেন, রোধ করেছিলেন, হৃদয়হীনের মতো। স্তালিন তো মারাত্মক কিছু পদক্ষেপ করেছিলেনই। এবং তাঁকে দেখে তাঁর বাধ্য অনুগামীরা আরও বেশি নির্দয় হয়েছিল।

সাক্ষাৎকার: শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE