Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

ঐতিহাসিক ইনাম

ভারতীয় জনতা পার্টির শাসনে এ দেশের সমাজ ও রাজনীতি কী পরিমাণ দুর্বিষহ সংকীর্ণতা ও অসহিষ্ণুতায় ঝাঁপ দিতেছে, এই একটি ঘটনাই তাহার মাপকাঠি হইয়া রহিল।

শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

দশ কোটি টাকা পুরস্কার। তাহার উপর গোটা পরিবারের সর্ববিধ আর্থিক ভার বহন। এমন একটি প্রতিশ্রুতি এই দরিদ্র দেশে সুলভ ব্যাপার নহে! বিশেষত কেবল এক জন ব্যক্তির মাথাটি কাটিয়া লইলেই যদি এই ভাবে জীবনের সমস্ত অর্থনৈতিক বন্দোবস্ত নিশ্চিত হইয়া যায়, তবে তো কথাই নাই। হরিয়ানায় বিজেপির মুখ্য মিডিয়া কোঅর্ডিনেটর সুরজপাল আমু প্রকাশ্য জনসভায় তাঁহার তামাম শ্রোতৃবর্গকে এই অসামান্য প্রলোভনের সামনে ফেলিয়াছেন। বলিয়াছেন, দীপিকা পাড়ুকোন ও সঞ্জয় লীলা ভংসালীর মাথা কাটিলে ‘মাথা’পিছু যে পাঁচ কোটি টাকার পুরস্কার মেরঠ হইতে ঘোষিত হইতেছে, তাহা স্বাগত তো বটেই, তবে তিনি স্বয়ং আরও বড় বাজি রাখিতে প্রস্তুত— দশ কোটি নগদ এবং অন্যান্য সুযোগসুবিধার নিশ্চয়তা তিনিই নিজ দায়িত্বে দিবেন। ভারতের রাজনীতিতে এই ঘটনা অভূতপূর্ব ও ঐতিহাসিক। মাথা কাটিবার ফতোয়া বা মাথা কাটিলে ইনাম দিবার ঘোষণা আগে শোনা যায় নাই, তাহা নহে। তবে এত দিন এ সব কথা শোনা যাইত করণী সেনা জাতীয় দেশের বিভিন্ন বিক্ষিপ্ত চরমভাবাপন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর মুখে। এখন কিন্তু চরমতা সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রা ধারণ করিয়াছে। খোদ শাসক দলের অন্যতম অফিস-চালকই মাথা কাটিলে ইনাম দিবার প্রস্তাব করিতেছেন। শাসক দলের অন্য কেহ আপত্তি করা দূরস্থান, মুখও খুলিতেছেন না। হরিয়ানার বিজেপি মুখপাত্র কোনও ক্রমে এইটুকু বলিয়াছেন যে, উহা বক্তার ব্যক্তিগত বিষয়, তাঁহাদের কোনও বক্তব্য নাই। মুখপাত্র মহাশয় বুঝিতে পারেন নাই, গোটা সমস্যার প্রকাণ্ডতা তাঁহার কথাটুকুতেই প্রকট। এমন ঘটনার পরও যখন তাঁহাদের কোনও ‘বক্তব্য’ থাকে না, তাহাই আসলে তাঁহাদের ‘বক্তব্য’।

ভারতীয় জনতা পার্টির শাসনে এ দেশের সমাজ ও রাজনীতি কী পরিমাণ দুর্বিষহ সংকীর্ণতা ও অসহিষ্ণুতায় ঝাঁপ দিতেছে, এই একটি ঘটনাই তাহার মাপকাঠি হইয়া রহিল। ভবিষ্যৎ ভারতে নরেন্দ্র মোদীর তুলনায় সুরজপাল আমুর ঐতিহাসিক গুরুত্ব খুব একটা কম দাঁড়াইবে না! আড়ালে আবডালে রক্ষণশীলতার বিষাক্ত চক্র কত তীব্র গতিতে ঘূর্ণ্যমাণ, আমু এবং তাঁহার সতীর্থরা তাহা সাক্ষাৎ বুঝাইয়া দিলেন। খোলা অঙ্গনে অত বড় হিংসাত্মক হুমকি দিয়াও তিনি সামান্যতম ভর্ৎসনা পাইলেন না। বিজেপি প্রধানমন্ত্রী হইতে বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী, বিজেপি কর্মকর্তা হইতে বিজেপি সদস্য, সকলেই এই বিষাক্ত চক্রের একই রকম উৎসাহী প্রচারক। ভারত নাকি পাকিস্তান হইতে চলিয়াছে, এত দিন এই আশঙ্কা শোনা যাইতেছিল। এখন আশঙ্কাটি পাল্টাইতে পারে। যে গণতন্ত্র একদা ভারতকে পাকিস্তান হইতে আলাদা করিয়াছিল, সেই গণতন্ত্রের চাপেই কি ভারত ফ্যাসি-ত্রাসের বিস্তারে পাকিস্তানকে ছাড়াইয়া যাইতে পারে? প্রশ্ন এখন ইহাই।

প্রশ্নটি গুরুতর। ইতিমধ্যেই মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশের তিন মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি বলিয়া দিয়াছেন, ‘পদ্মাবতী’ সিনেমা তাঁহাদের রাজ্যে মুক্তি পাইবে না। রাজ্যের জনসাংখ্যিক হিসাব অবশ্যই তাঁহাদের এই অবস্থানের নির্ণায়ক। মধ্যপ্রদেশে রাজপুত বাসিন্দা প্রচুর, তাই মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান বাজে সময় খরচ করেন নাই, চটপট নিজের শাসন অটল রাখিবার পথ করিয়া লইয়াছেন। ‘পদ্মাবতী’ সিনেমার কাহিনি ইতিহাসসম্মত কি না, সিনেমার আদৌ ইতিহাসসম্মত হইবার দায় আছে কি না, ইতিহাস ও লোককথার মধ্যে সম্পর্কটি সরলরৈখিক কি না, এই সব কূট প্রশ্নের অপেক্ষা জনতার ভাবাবেগই এখন তাঁহাদের রাজনীতির প্রধান বিবেচ্য ও বিচার্য। গণতন্ত্র তবে কালে দিনে এখানেই পৌঁছাইতে চায়। আর বিজেপির মূল শাসননীতিই যেহেতু সমাজ অর্থনীতিকে তুড়ি মারিয়া উড়াইয়া কেবল ভাবাবেগ দিয়া রাজনীতির ভেলাকে ঠেলা দেওয়া— ফ্যাসি-ত্রাসের উত্তাল তরঙ্গ এখন গোটা দেশে ফুঁসিয়া উঠিতেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE